জাহাঙ্গীর একটিও কথা না বলিয়া একটা পাঁচ টাকার নোট গাড়োয়ানের হাতে দিয়া গাড়ি হইতে সমস্ত জিনিস নিজে বহিয়া প্ল্যাটফর্মে আনিল। গাড়োয়ান এই আশ্চর্য লোকটির কোনো কিছুই যেন বুঝিতে পারিতেছিল না। সে আর গোলমাল না করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জাহাঙ্গীর তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘এই, শোন!’ বলিয়াই সে ল্যাম্পপোস্টের কাছে দাঁড়াইয়া চিঠি লিখিতে লাগিল।
চিঠি লেখা শেষ করিয়া গাড়োয়ানকে বলিল, ‘দেখ, এই চিঠি যদি ভূণীকে লুকিয়ে দিতে পারিস – তোকে দশ টাকা বকশিশ দেব। পারবি?’
গাড়োয়ান হতভম্ব লইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর তাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘শালা হাঁদারাম! হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কী? ভূণীকে চিনিস? হারুণের বোন?’
গাড়োয়ান কম্পিতকণ্ঠে বলিল, ‘হুজুর উয়াকে চিনব না? এই তো সেদিন আমাদের কাছে ড্যাংডিঙিয়ে বড়ো হয়ে উঠল!’
জাহাঙ্গীর তাহার কাছে গিয়া কণ্ঠস্বর কমাইয়া বলিল, ‘তাকেই পৌঁছে দিতে হবে এই চিঠিটা, বুঝলি? তোর মেয়ে-টেয়ে কেউ নেই বাড়িতে? তার হাত দিয়ে… বুঝলি এখন?’
গাড়োয়ান একটু কী যেন ভাবিল, তাহার পর বলিল, ‘পারব হুজুর। দেন!’
জাহাঙ্গীর চিঠিটা ও দশ টাকার নোট তাহার হাতে দিয়া বলিল, ‘কাল সন্ধ্যায় আমায় এইখানে পাবি এসে। কী উত্তর দেয়, নিয়ে আসবি। তা হলে আরও দশ টাকা বকশিশ, বুঝলি?’
গাড়োয়ান আনন্দ-গদগদ কণ্ঠে বলিল, ‘হুজুর মা বাপ! কালই সনঝেবেলা আমি হাজির হব এসে। হুজুর এইখেনেই থাকবেন তো?’
জাহাঙ্গীর ‘হুঁ’ বলিয়া অন্যমনস্কভাবে স্টেশনের ভিতরে চলিয়া গেল।
ওয়েটিং রুমে ঢুকিয়াই সে একেবারে চমকিয়া উঠিল। সেখানে ইজিচেয়ারে শুইয়া সাহেবি পোশাকপরা এক জন লোক নিশ্চিন্ত আরামে সিগার ফুঁকিতেছিল। জাহাঙ্গীর লোকটিকে আর একবার ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিল, তাহার পর কাছে গিয়া বলিল, ‘প্রমতদা এখানে?’
প্রমত্তও চমকিয়া উঠিয়াছিল। জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘চুপ! এখানে প্রমতদা বলে কেউ আসেনি!’ বলিয়াই চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘বস এইখানে। তার পর তুই এখানে কোথা?’
জাহাঙ্গীর সমস্ত বলিল।
প্রমত্ত সমস্ত শুনিয়া হাসিয়া বলিল, ‘বেশ বেড়াচ্ছিস তা হলে উপন্যাসের নায়ক হয়ে! কিন্তু ভালো করিসনি জাহাঙ্গীর তুই এখানে এসে। যাক, তুই আজই কোলকাতা চলে যা। একটু পরেই ট্রেন আসবে!’
জাহাঙ্গীর বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘আর আপনি?’
প্রমত্ত বলিল, ‘আবার প্রশ্ন? আমার অন্য জায়গায় কাজ আছে।’
কী যে কাজ জাহাঙ্গীরের তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। ইহা লইয়া আর কিছু প্রশ্ন যে সে করিতে পারে না, তাহাও সে জানে। তবু সে একটু ঘুরাইয়া বলিল, ‘আমাকে যে কাল পর্যন্ত থাকতে হচ্ছে প্রমতদা!’ বলিয়াই সে হাসিয়া বলিল, ‘থুড়ি, মিস্টার চাকলাদার!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘আমার সুটকেসের লেখা নাম পড়ে ফেলেছিস বুঝি? কিন্তু দেয়ালগুলোরও চোখকান আছে রে! একটু সাবধানে কথাবার্তা বলবি। সে যাক, তুই এখানে থাকবি কেন, বল তো! আমার জন্য তোর কোনো চিন্তা নেই।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আপনার নেই, কিন্তু আমাদের তো থাকা উচিত। তা ছাড়া’ – বলিয়াই একটু থামিয়া চক্ষু নত করিয়া বলিল, ‘কাল চিঠির উত্তর আসবে আমার!’
প্রমত্ত হাসিল না। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া অনেকক্ষণ কী ভাবিল। তাহার পর আস্তে আস্তে বলিল, ‘তবে তুই থাক। কিন্তু খুব সাবধান। পিছনে টিকটিকি লেগেছে! অবশ্য, তোর ভাবনা নেই। কেননা মুসলমান যুবককে তারা এখনও সন্দেহ করেনি। সাবধানের মার নেই।’
প্রমত্ত আবার যেন কী ভাবিতে লাগিল।
একটু পরে সে বলিয়া উঠিল, ‘দেখ জাহাঙ্গীর, তোর আচকান পায়জামা আছে সঙ্গে?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আছে।’
প্রমত্ত বলিল, ‘এক্ষুনি নিয়ে আয়!’ বলিয়াই ঘড়ির দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আর বেশি সময় নেই! যা, শিগগির আন!’
জাহাঙ্গীর তাহার আচকান পায়জামা আনিলে প্রমত্ত বাথরুমে ঢুকিয়া একটু পরে যখন তাহা পরিয়া বাহির হইয়া আসিল, তখন জাহাঙ্গীর একটু জোরে হাসিয়া বলিল, ‘আদাব আরজ মউলবি সাব! আপকে ইসমে শরিফ!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘কেফায়েতুল্লা।’ তার পর নিম্নকন্ঠে বলিল, ‘আমি যাচ্ছি এখনই! কেমন যেন গন্ধ পাচ্ছি রে! তুই এইখানেই ঘুমো। দরকার হলে ডাকব!’ বলিয়াই প্রমত্ত টার্কি-ফেজ মাথায় দিয়া ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বাহির হইয়া গেল!
জাহাঙ্গীর সেইখানে ইজিচেয়ারে শুইয়া শুইয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িল।
রাত্রি প্রায় তিনটার সময় সে কাহার ঠেলায় জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, সামনেই একজন ইউরোপিয়ান সাহেব। তাহার পিছনে তিন-চার জন বাঙালি বাবু।
সে একটু বিরক্ত হইয়াই ইংরাজিতে বলিল, ‘আপনি কী চান? এরূপভাবে জাগাবার রীতি ভদ্রতা-বিরুদ্ধ!’
সাহেব একটু থতমত খাইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিল, ‘মাপ করবেন, আমি আপনাকে আমার বন্ধু মি. চাকলাদার মনে করেছিলুম। তিনি বোধ হয় এখানেই ছিলেন, বলতে পারেন , তিনি কোথায় গেছেন?’
জাহাঙ্গীর তেমনি বিরক্তির সুরে বলিল, ‘জানি না কে আপনার চাকলাদার! আমি কাউকেই দেখিনি এখানে।’
সাহেব আবার ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীরের বুঝিতে বাকি রহিল না ইনি কোন সাহেব!
এক অজানা আশঙ্কায় তাহার বুক কাঁপিতে লাগিল। সে আর একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তাহার বুকের কাছে তাহার শ্রেষ্ঠ বন্ধু – তাহার আত্মরক্ষার অস্ত্র আছে কি না।