জাহাঙ্গীর যখন বলিল, সে কিছুতেই তাহার বোঝা আর এক জন মানুষের অর্থাৎ কুলির মাথায় চড়াইয়া দিয়া তাহার অবমাননা করিবে না, বরং সে তাহার এই আভিজাত্যের অভিশাপ নিজেরই মাথায় তুলিয়া বাহির হইয়া যাইবে, তখন হারুণ একরকম জোর করিয়াই তাহার জন্য গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করিয়া দিল।
গোরুর গাড়িতে চড়িতে জাহাঙ্গীরের শহুরে সংস্কারে একটু বাধিলেও সে আর আপত্তি করিল না। একটু কৌতূহল ও যে হইল না, এমন নয়!
হারুণ হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘আশা করি গো-জাতির প্রতি তোমার মানবত্ববোদ আজও প্রবল হয়ে ওঠেনি!’
জাহাঙ্গীরও হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘না বন্ধু! বাঙালির বুদ্ধি আজও সেরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি। ওরা হনুমান ও গোরুর পূজা করেনি কখনও! ওই দুটো জীব বাংলার বাইরেরই দেবতা হয়ে আছেন!…’
গোরুর গাড়িতে চড়িয়া ক্রোশ-খানেক যাইবার পর জাহাঙ্গীরের কৌতূহল ও উৎসাহ একেবারে জল হইয়া গেল। অসমান গ্রাম্যপথে ঘন্টায় প্রায় এক মাইল গতিতে সনাতন গো-যান যে বিচিত্র শব্দ করিয়া ধূলি-পটল উড়াইয়া চলিতেছিল, তাহাতে জাহাঙ্গীরের ধৈর্য ধরিয়া বসিয়া থাকা একপ্রকার অসহ্য হইয়া উঠিল। অনবরত ঝাঁকুনি খাইতে খাইতে তাহার মনে পড়িল বহু পূর্বে তাহার একবার ডেঙ্গু জ্বর হইয়াছিল, তাহাতে যে গা-হাত-পায়ের ব্যথা হইয়াছিল, সে বোধ হয় ইহার কাছে কিছুই নয়। সে আর থাকিতে না পারিয়া নামিয়া পড়াতে বেচারা গাড়োয়ান বিনয়-নম্রস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘জি, নামলেন কেনে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘তোমার “জি” সাধ করে নামলেন না বাপু, তোমার গাড়ি তাকে নামিয়ে তবে ছাড়লে।’
গাড়োয়ান গাড়ি থামাইয়া বলিল, ‘জি, গাড়িতে উঠে বসুন, আমি একুটুকু চাঁওড় করে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এই শালার গোরু হুজুর একটু বেয়াড়া, তাইতে ভয় করে – কোথায় গোবোদে ফেলিয়ে দিবে। নইলে দাঁদাড়ে নিয়ে যেতুম!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তুমি “দাঁদাড়ে” নিয়ে চলো বাপু, আমি খানিকটা হেঁটে যাই!’ বলিয়াই গাড়ির পিছনে পিছনে আস্তে আস্তে হাঁটিয়া চলিল।
ধূলিধূসরিত জনবিরল গ্রাম্যপথ। দুই পাশে মাঠ ধু ধু করিতেছে। যেন উদাসিনী বিরহিণী। দূরে ছায়ানিবিড়পল্লি – ঝিল্লির ঘুমপাড়ানিয়া গানে যেন মায়ের কোলে শিশুর মতো ঘুমাইতেছে। জাহাঙ্গীরের মন কেমন যেন উদাস হইয়া গেল।
পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, সে যেন উদাস বাউল , না-জানার সন্ধানে এই পথে পথে গান গাহিয়া ফিরিতে আসিয়াছে। যাহারা তাহার পথে আসিতেছে পরিচিতের রূপে তাহারা তাহার কেহ নয়। যে উদাসিনীর অভিসারে সে চলিয়াছে, সে এই পল্লিবাটের না-জানা উদাসিনী। তাহাকে অনুভব করা যায়, রূপের সীমায় সে অসীমা ধরা দেয় না…
এমন সময় গাড়ির গো-বেচারি গো-যুগলকে গাড়োয়ান এমন ভাষায় সম্ভাষণ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল যাহাতে জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন এক নিমিষে টুটিয়া গেল। হাসিতে হাসিতে সে পথের ধারেই ধুলার উপর বসিয়া পড়িল। একটু পরে পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, কেন এ দেশে এত বাউল এত চারণ এত কবির সৃষ্টি হইল। এই উদাস, তপস্বীর ধ্যানলোকের মতো শান্ত নির্জন ঘাটমাঠ যেন মানুষকে কেবলই তাহার আপন অতলতার মাঝে ডুব দিতে ইঙ্গিত করে। এ তেপান্তরে পথের মায়া যেন কেবলই ঘর ভুলায়, একটানা পুরবি সুরের মতো করুণ বিচ্ছেদ-ব্যথায় মনকে ভরিয়া তোলে, গৃহীর উত্তরীয় বাউলের গৈরিকে রাঙিয়া উঠে!…
এতক্ষণ যতবার তাহার ভূণীকে মনে পড়িয়াছে, ততবারই তাহার মন অবিশ্বাসের কালিতে কালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এই জনবিরল উদাস প্রান্তরে আসন্ন সন্ধ্যায় চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, এমনই একটি শান্ত পল্লিপ্রান্তে ছায়া-সুশীতল কুটির রচনা করিয়া তাহাকে লইয়া সে স্বর্গ রচনা করিতে পারে। কিন্তু তাহা হইতে পারে না! তাহার পিতার পাপ তাহার রক্তকে কলুষিত করিয়াছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে তাহার পিতার মতোই ব্যভিচারী হইয়া উঠিতে পারে! সে জানে, তাহার রক্তের চঞ্চলতাকে, তাহার ভীষণ উদ্দাম প্রবৃত্তিকে সংযত করিতে তাহার কত বেগ পাইতে হইয়াছে। তাহার স্বর, তাহার অবয়ব, তাহার রক্ত সমস্তই ফররোখ সাহেবের। উহার মধ্যে যেটুকু জাহাঙ্গীর, তাহা এই পশুর কাছে টিকিতে পারে না। পাপই যদি করিতে হয়, পশুর কবলেই যদি আত্মাহুতি দিতে হয়, তবে সে একাই দিবে, এ পাপের সাথি অন্যকে করিবে না!
তাহার পিতার কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মাথায় যেন খুন চাপিয়া গেল। বুকের কাছে লুকানো রিভলভারটা একটানে বাহির করিয়া নিজের ললাটের কাছে ধরিল। আবার কী মনে করিয়া সেটাকে যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া গোরুর গাড়িকে পিছনে ফেলিয়া দৃপ্তপদে পথ চলিতে লাগিল।
যাইবার সময় গাড়োয়ানের দিকে রোষ-কষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিয়া গেল, ‘শালা, তুমি যদি তাড়াতাড়ি গাড়ি না চালাও, তাহলে এই বনের মধ্যে তোমায় মেরে পুঁতে ফেলব!’
গাড়োয়ান বেচারা ভয়ে অভিভূত হইয়া প্রাণপণে জাহাঙ্গীরের সাথে গাড়ি চালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল! জাহাঙ্গীরের রক্তবর্ণ চোখ-মুখ দেখিয়া মনে হইল, সে ইচ্ছা করিলে সত্যসত্যই তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারে!…
শিউড়ি যখন তাহারা আসিয়া পৌঁছিল, তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়া গিয়াছে। গাড়োয়ান কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলিল, ‘হুজুর, বলদ দুটো আর বাঁচবে না, মর মর হয়ে গিয়েছে হুজুর! সারা রাস্তা আমি মেরে দৌড়িয়ে নিয়ে এসেছি হুজুর!’