ভূণী এবার ছেলেমানুষের মতো তরল কণ্ঠে চেঁচাইয়া উঠিল, ‘অ মা! কী হবে! পান খেয়ে ফেলেছেন? ফেলে দিন, ফেলে দিন! বেশ! ফেলবেন না তো!’ বলিয়াই বহুদিনের রোগক্লান্ত রুগির মতো শান্তকণ্ঠে বলিতে লাগিল, ‘চির-নির্বাসনই তো দিয়ে গেলেন। আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে এ আমার ধ্রুব ধারণা যে, আর আমাদের কোনোকালেই দেখা হবে না।’ তাহার পরে একটু থামিয়া চোখমুখ ডাঁশা আপেলের মতো লাল করিয়া সলজ্জকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘আমাদের যদি আজ সত্যিসত্যিই বিয়ে হয়ে যেত, তাহলে এক বছরেও হয়তো এত কথা এমন করে বলতে পারতাম না আপনার কাছে। দুর্দিন মানুষকে এমনই বেহায়া করে তোলে! আমার যে এক মুহূর্তেই জীবনের সাধ মিটিয়ে ফেলতে হবে। আমার মতো দুর্ভাগিনি এক কারবালার সকিনা ছাড়া বুঝি কেউ নেই!’ বলিয়াই সে ফোঁপাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ভিতরে চলিয়া গেল!
জাহাঙ্গীরের কেবলই মনে হইতে লাগিল সে বুঝি ইহজগতে নাই। সে যেন স্বপ্ন দেখিতেছে। তাহার সমস্ত অঙ্গ যেন কাহার অভিশাপে প্রস্তরীভূত হইয়া যাইতেছে! সে না পারিল নড়িতে, না পারিল একটা বাক্য উচ্চারণ করিতে! কিন্তু তাহার আর বিস্ময়ের অবধি রহিল না, যখন সে দেখিল, অল্প পরেই ভূণী আর এক রেকাবি সন্দেশ লইয়া তাহার সম্মুখে রাখিতেছে। তাহার মনে হইল, কে যেন জাদু করিয়া তাহাকে এই রহস্যপুরীতে বন্দি করিতেছে! সে যেন সকল দেশের সকল গল্প-কাহিনির নায়ক – রূপকুমার। হঠাৎ সে অভিভূতের মতো বলিয়া ফেলিল, ‘তহমিনা! তুমি আমার সাথে যাবে? জানি না, তুমি কারবালার সকিনা, না, সিস্তানের তহমিনা। বলো, তুমি যাবে?’
ভূণী দৃপ্তকণ্ঠে বলিল, ‘না!’
জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন টুটিয়া গেল। সে আবার বহুক্ষণ ধরিয়া ভূণীকে দেখিল। দেখিয়া যখন সাধ মিটিতে চায় না; হায় রে ভুখারি অবিশ্বাসী চোখ! তবু সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন যাবে না? তুমিই না বলছিলে, তোমার মা যার হাতে তোমায় সঁপে দিয়েছেন, তার চেয়ে বড়ো সত্য তোমার আর নেই।’
ভূণী মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘এখনও তাই বলছি। তবু এমন করে তো যাওয়া যায় না। আপনাকে আমি উপদেশ দিতে পারি, এত বড়ো স্পর্ধা আমার নেই। আমার অন্তরের সত্য যত গভীরই হউক, তবু তাকে সমাজের কাছে রং বদলিয়ে নিতে হবে। নইলে কেউই সুখী হতে পারব না।’
জাহাঙ্গীর অনেকক্ষণ ধরিয়া কী ভাবিল, তাহার পর কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘তা হতে পারে না ভূণী, আমি এতক্ষণ ভুল বকছিলাম। আমায় ক্ষমা করো। যে প্রেমে অবিশ্বাস করে, তার মতো হতভাগ্য বুঝি বিশ্বে কেউ নেই। তার কোথাও কোনো কিছুতেই সুখ নেই। আমায় নিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না, আমিও তোমায় নিয়ে – শুধু তোমায় বলে নয় – কোনো নারীকে নিয়েই সুখী হতে পারব না। যে সত্যকে আমি চোখের সামনে দেখি, তাকেও বিশ্বাস করতে পারিনে, আমার রক্তে রক্তে যেন প্রতিধ্বনি ওঠে, ভুল, ভুল, এ সব মিথ্যা, ছলনা! আমি তোমায় আমারও অজানিতে দুঃখ দিয়ে গেলাম। কিন্তু তুমি তো জান – আমার অপরাধ কতটুকু! তোমার কোনোদিন কোনো উপকার করেও যদি আমার এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধের লাঘব করতে পারি, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব – শুধু এইটুকুই মনে রেখো। আমার আর সব ভুলে যেয়ো!’ শেষের কথা কয়টি বলিবার সময় তাহার কণ্ঠ যেন ভাঙিয়া আসিতেছিল! – সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়া বলিল, ‘তবে যাই এখন!’
ভূণী ভগ্নকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘অনুগ্রহ করে আপনার এই কাপড় কয়খানা নিয়ে যান! একটু বসুন, আমি আসছি।’
জাহাঙ্গীর চলিয়া যাইতেছিল! ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আমি তো তোমায় নির্বাসনই দিলাম, ওই শাড়ি তোমার জেলের পোশাক!’
তহমিনা সেইখানেই ছিন্নকণ্ঠ কপোতীর মতো লুটাইয়া পড়িয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘আমি পারব না, পারব না এ শাস্তি বইতে! নিষ্ঠুর, আমায় তুমি প্রাণদণ্ড দিয়ে যাও, এ নির্বাসন দিয়ো না , দিয়ো না!’
দুটো পাপিয়ায় তখনও আঙিনায় যেন আড়াআড়ি করিয়া ডাকিতেছিল, ‘পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা! চোখ গেল, চোখ গেল!’
কুহেলিকা – ১০
সন্ধ্যার পূর্বেই জাহাঙ্গীর গোরুর গাড়িতে চড়িয়া শিউড়ি চলিয়া গেল।
সন্ধ্যার বিষণ্ণতা এমন করিয়া বুঝি আর কখনও নামে নাই হারুণদের বাড়িতে।
ভূণীর যখন জ্ঞান হইল, তখন তাহার সর্বপ্রথম এই প্রার্থনাই অন্তর ভরিয়া গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল, ‘ধরণি দ্বিধা হও! এ মুখ যেন আর দেখাইতে না হয়!’
সেও কি সত্যসত্যই তাহার মাতার ন্যায় উন্মাদিনী হইল? নহিলে এত কথা এমন লজ্জাহীনার মতো সে বলিল কেমন করিয়া?… সন্ধ্যার এ অন্ধকার যেন আর না কাটে! সে আর আলোকের মুখ দেখিতে পারিবে না।
কেহ সন্ধ্যা-দীপ জ্বালিলও না। কেহ জ্বালিতেও বলিল না। আলো জ্বলিয়া উঠিলে বুঝি এ বেদনা এ লজ্জার কালিমা দ্বিগুণতর হইয়া দেখা দিবে।
বাড়ির প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের কাছে অপরাধী!
উন্মাদেনী মাতার আবোল-তাবোল বকুনির মাঝে ক্রন্দনও শোনা যাইতেছিল, ‘মিনা আমার! বাপ আমার! এসে আবার চলে গেলি?’
হারুণ এতক্ষণ একটি পুকুরের নির্জন পাড়ে বসিয়া আকাশ-পাতাল চিন্তা করিতেছিল। জাহাঙ্গীরের তো কোনো অপরাধই নাই। কিন্তু নাই বা বলি কেমন করিয়া? সে কেন এ দরিদ্রের বাড়ি আসিতে চাহিল? যদি আসিলই এবং দৈবক্রমে এ দুর্ঘটনা ঘটিলই যদি, সে কেন ইহার মীমাংসা করিয়া গেল না? হতে পারে, তাহারা দরিদ্র, কিন্তু বংশ গৌরবে তাহারা তো একটুও খাটো নয়। আর ওই ভূণী, অমন অপরূপ সুন্দরী, অপূর্ব বুদ্ধিমতী মেয়েও কি তাহার বধূ হইবার অযোগ্য? তাহাকে যে অবহেলা করিয়া গেল, এই বেহেশ্তী ফুলের মালাকে যে পদদলিত করিয়া গেল, সে কি মানুষ? ভালোই হইয়াছে, ওই হৃদয়হীন বাঁদরের গলায় এ মুক্তার মালা শোভা পাইত না বলিয়াই এ অঘটন ঘটিয়া গেল!… কিন্তু ভূণী! উহার কী হইবে? জাহাঙ্গীরের সাথে তাহার সমস্ত কথাই সে শুনিয়াছে, ভূণীকে সে ভালো করিয়াই চিনে। সে ভাঙিবে কিন্তু নোয়াইবে না! সে ভয় করিতে লাগিল, এইবার তাহার অন্ধ পিতা আর বাঁচিবে না!