জাহাঙ্গীরের মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীর চন্দ্রসূর্য সমস্ত ডুবিয়া গিয়াছে। একাকী অন্ধকারে সে অতল হইতে অতলতর গহ্বরে তলাইয়া যাইতেছে।
কিন্তু সে মুহূর্তকালের জন্য। একটু পরেই সে সামলাইয়া উঠিল। সে আর কিছু বলিতে যাইবার পূর্বেই ভূণী ক্ষীণ হাসি হাসিয়া বলিল, ‘আপনি যা বলবেন তা আমি জানি। ফাঁসির আসামি যেমন করে তার দণ্ডাজ্ঞা শোনে, আপনার কাছ থেকে হয়তো তেমনি করেই তেমনই কঠোর কিছুই শুনতে হবে; আমি তার জন্য প্রস্তুত আছি। তবুও আমি আমার যা বলবার বললাম। আপনি আমায় পাগল বা ওই রকম অদ্ভুত কোনো কিছু ভাবছেন, না?’ – আবার সেই অস্তমান শশীকলার মতো কান্নাভরা হাসি!
জাহাঙ্গীর এতক্ষণে তাহার পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়া ভূণীর দিকে তাকাইয়া দেখিল। তাহার চকচকে চোখ নিমেষে ব্যথায় ম্লান হইয়া উঠিল। ওই নিমেষের দৃষ্টি বিনিময়। তাহার মনে হইল, ওই অপূর্ব সুন্দর দুইটি চক্ষুর জন্যই সে সর্বত্যাগী হইতে পারে!… হঠাৎ তাহার সুপ্ত আহত অভিমান যেন নিদ্রোত্থিত কেশরীর ন্যায় জাগিয়া উঠিল। বন-হরিণীর মতো চক্ষু ইহাদের, হরিণীর মতোই মায়াবী ইহারা, তবু ইহারা শিকারের জীব! ইহাদের হত্যা করায় পৌরুষও নাই, করিলে লজ্জাও নাই! তাহার মনে হইতে লাগিল, সে জাহাঙ্গীর নয় – সে শুধু মদ্যপ চরিত্রহীন ফররোখ সাহেবের পুত্র!
এইবার সে একটু বক্র-হাসি হাসিয়াই বলিল, ‘তোমার মা উন্মাদিনী হলেও তোমায় তা ভাবতে পারি না ভূণী। আর কোনো মেয়ে হলে তাকে ধূর্ত বলতাম – প্রগল্ভা না বলে; কিন্তু তোমায় তা বলতে আমার মতো কশাই-এরও বাধবে! আমার কপালই এই রকম। যারাই আমার জীবনে বিপর্যয় এনেছে, তাদের সকলেই অদ্ভুত এক-একটি জীব। কিন্তু সে কথা যাক। তুমি এখনই বলছিলে – ফাঁসির আসামির মতোই আমার দণ্ডাজ্ঞা শুনতে প্রস্তুত আছ। আমি যদি সত্যিসত্যিই তোমার যাবজ্জীবন নির্বাসনের দণ্ডাজ্ঞা দিই, তুমি তা সইতে পারবে?’ বলিয়াই নিষ্ঠুরের মতো হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ভূণী মুহূর্তের জন্য অন্তরে কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু তাহার পরেই সে গলবস্ত্র হইয়া জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘আপনার ওই দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করলাম!’ তাহার পর ভিতরে চলিয়া যাইতে যাইতে বলিল, ‘অনেক অদ্ভুত জীবই তো দেখেছেন জীবনে, এবং সে জীব-হত্যায় আপনার হাতযশও আছে মনে হচ্ছে, এইবার আরেকটা জীব দেখে গেলেন! কিন্তু মনে রাখবেন, যাদের জীব-হত্যাই পেশা, তাদের সে ঋণ একদিন শোধ করতে হয় ওই বন্যজীবের হাতেই!’ – সে রানির মতো সগর্বে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর একটু চিৎকার করিয়াই বলিয়া উঠিল, ‘আমার শেষ কথা শুনে যাও তহমিনা, নইলে আমায় নিয়ে সবচেয়ে বড়ো দুঃখ পোহাতে হবে তোমার!’ ভূণী ভিতর হইতে বলিল, ‘আমি এখান থেকেই আপনার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি বলুন।’
জাহাঙ্গীর সহসা এই ব্যঙ্গোক্তিতে ক্রুদ্ধ হইলেও তাহার অপূর্ব আত্মসংযমের বলে কণ্ঠ যথাসম্ভব শান্ত করিয়া বলিল, ‘আমি প্রেমও বিশ্বাস করিনে, পৃথিবীর কোনো নারীকেও বিশ্বাস করিনে! মনে হচ্ছে, তোমার সব কথাই আর-কারুর শেখানো, অথবা ও-গুলো অতিরিক্ত নভেল পড়ার বদহজম! তোমাদের জাতটারই নির্বাসন হওয়া উচিত। একেবারে কালাপানি!’
ভূণী রেকাবিতে করিয়া এক রেকাবি সন্দেশ ও এক গ্লাস পানি লইয়া জাহাঙ্গীরের সামনে রাখিতে রাখিতে সহজ কণ্ঠেই বলিল, ‘আপনি বড্ড দুর্মুখ! যাবেনই তো, যাবার সময় একটু মিষ্টিমুখ করে যান।’ বলিয়াই সে হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘মাফ করবেন, আপনার দেওয়া মিষ্টি দিয়েই আপনার তেতো মুখ মিষ্টি করতে হচ্ছে! জানেনই তো, আমরা কত গরিব! তাতে আবার পাড়াগেঁয়ে। একটা ঘরের মিষ্টি দিয়ে আপনার জমিদারি মুখের ঝাল মিটাতে পারলাম না! আপনি খান, আমি দুটো পান সেজে আনি।’ বলিয়াই সে ভিতরে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর আর একটি কথাও না বলিয়া সুবোধ বালকের মতো রেকাবির মিষ্টি গলাধঃকরণ করিতে লাগিল। তাহার আজ কেবলই মনে হইতে লাগিল, মিষ্টি যে এত মিষ্টি হয় – তাহা সে জীবনে উপলব্ধি করে নাই, হয়তো আর কখনও করিবেও না। কিন্তু এই নারী, এই প্রগল্ভা তরুণী! এ কোথা হইতে আসিল? বনফুলের এই সৌন্দর্য, এত সুবাস! গহন বনের অন্ধকারে এ কোন কস্তুরীমৃগ তাহার মেশ্ক-খোসবুতে সারা বন আমোদিত করিয়া তুলিতেছে? কয়লার খনিতে এ কোন কোহিনূর লুকাইয়া ছিল? জাহাঙ্গীর যেন দিশা হারাইল। সে জাহাঙ্গীর নয়, বিলাসী ফররোখ সাহেবের পুত্র নয়, সে ‘শিভালরি’ যুগের বীরনায়ক, বিংশ শতাব্দীর সভ্য যুবক! সে এই মহীয়সী নারীর অবমাননা করিবে না! আপনার অজ্ঞাতেই তাহার কণ্ঠ দিয়া উচ্চারিত হইল, ‘তহমিনা! তহমিনা!’
ভূণী তশতরীতে পান লইয়া আসিতেছিল। জাহাঙ্গীরের এই অস্বাভাবিক স্বরে একটু বিস্ময়ান্বিত হইয়াই সে নিকটে আসিয়া বলিল, ‘আমায় ডাকছিলেন?’
জাহাঙ্গীর অপ্রতিভ হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল, ‘না?’ জাহাঙ্গীর নিজেই চমকিত হইয়া উঠিল। তাহার নিজের কণ্ঠস্বরে যে এত মধু আছে তাহা সে নিজেও জানিত না।
ভূণী স্নেহ-গদগদ কন্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘এই তো বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতো সব মিষ্টিই খেয়েছেন দেখছি। দেখুন, আপনি বড্ড বদরাগী! হয়তো আপনার কোনো অসুখ-বিসুখ আছে, দোহাই! কলকাতা গিয়ে একটু চিকিৎসা করাবেন!’ বলিয়াই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তাই তো বলি, যে লোক দু-হাতে এত হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি বিলাতে পারে, তার মেজাজ কি এত তেতো হয়? আর দুটো মিষ্টি এনে দেই, লক্ষ্মীটি, “না” বলবেন না। সেই কখন দুপুর রাত্তিরে কলকাতা পৌঁছোবেন, আর খিদের চোটে রাস্তায় হয়তো কাউকে খুন করেই বসবেন! যা মেজাজ, বাপরে!’ বলিয়াই জাহাঙ্গীরের দিকে গভীর সানুরাগ দৃষ্টি দিয়া তাকাইতেই দেখিল, জাহাঙ্গীর মুখে ক্রমাগত পান ঠাসিতেছে।