মোমি তাহার সিল্কের শাড়ি খুলিয়া ফেলিয়া আবার সেই ছিন্ন মলিন শাড়িটি পরিয়া গৃহকর্মে রত হইয়াছে। ওইটুকু মেয়ে, তাহার এই দুঃখ ঢাকিবার কঠোর প্রয়াস দেখিয়া অশ্রু সংবরণ করা দায় হইয়া উঠে! এ যে কত বড়ো দুঃখ, কোথা দিয়া কী হইল, সে হয়তো ভালো করিয়া বুঝিতেই পারে নাই। তাহার চারিপাশে সে যেন কাহাদের দীর্ঘশ্বাস, কাহাদের নিঃশব্দ ক্রন্দন অনুভব করিতেছে। কীসের এ বিষাদ, সে তাহা জানে না! তাহাকে সবচেয়ে বেশি বেদনা দিয়াছে – জাহাঙ্গীরের আজই কলিকাতা চলিয়া যাওয়ার আয়োজন!
উন্মাদিনী মাতা অঘোরে ঘুমাইতেছেন – উন্মাদিনী নিয়তির মতোই নির্বিকার নিশ্চিন্ত আরামে!
ভূণী তাহার সকালের-পরা সাজসজ্জা লইয়া পাষাণ-প্রতিমার মতো বসিয়া আছে। হারুণ একবার চুপি চুপি তাহাকে ও অলক্ষুণে বস্ত্র খুলিয়া ফেলিতে বলায় সে অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়াছিল, ‘ওকে যেতে দাও ভাই, তার পর চিরকালের জন্যই খুলে ফেলব!’ ইহার পর হারুণ আর কিছু বলিতে সাহস করে নাই।
দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। জাহাঙ্গীর সমস্ত বাঁধিয়া ছাঁদিয়া সহজ শান্তভাবে হারুণদের আঙিনায় আসিয়া দাঁড়াইল। হারুণ তাহাকে কিছু বলিবার আগেই ভূণী ভিতর হইতে ডাকিল, ‘মেজোভাই, শুনে যাও।’
হারুণ জাহাঙ্গীর দু-জনারই বুক কাঁপিয়া উঠিল।
ভূণী তাহার সেই বধূবেশ লইয়া অকুতোভয়ে বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘বা-জান! তুমি দলিজে যাও তো একটু!’
ইহা যেন অনুরোধ নয়, আদেশ।
মনে হইল, অন্ধ পিতা সব বুঝিয়াছেন। মোবারককে ডাকিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।
জাহাঙ্গীরের ভয় করিতে লাগিল, বুঝি মাতার মতো কন্যারও মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়াছে। সে আঙিনায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতে লাগিল – নিজের জন্য নয়; এই হতভাগিনির দুঃখে! তাহার জীবনদেবতা জীবন লইয়া কী খেলা খেলেন, তাহা দেখিবার জন্য সে নিজেকে অম্লান বদনে তাঁহার হাতেই সঁপিয়া দিয়াছে। আজিকার বজ্রপাতকেও সে তাই মাথা পাতিয়াই গ্রহণ করিবে!
ভূণী একটু জোরেই হারুণকে বলিল, ‘মেজোভাই, আমি তোমার বন্ধুর সাথে দুটো কথা বলতে পারি?’
হারুণ অবাক হইয়া ভূণীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
ভূণী তেমনই সতেজ কণ্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘বুঝেছি মেজোভাই, তুমি কী ভাবছ। কিন্তু ভাববার কিছুই নেই এতে। আমার মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা আমার চেয়ে কেউ বুঝবে না। আমি তোমারই তো ছোটো বোন। আমায় দিয়ে অন্যায় কিছু হবে না, এ তুমি জেনে রেখো। আমি আমার দুর্ভাগ্যের শেষটুকু জেনে নিতে চাই।’
হারুণের দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিল, সে আর দাঁড়াইতে পারিল না। সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে তাহার মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল।
ভূণী জাহাঙ্গীরের চোখের দিকে চাহিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, ‘আপনার সঙ্গে দুটো কথা আছে, একটু ভিতরে এসে বসবেন?’
জাহাঙ্গীর কলের পুতুলের মতো সে আদেশ পালন করিল।
ভূণী একেবারে জাহাঙ্গীরের পায়ের নীচে বসিয়া পড়িয়া অশ্রু-টলমল ডাগর চক্ষু দুটি ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘আপনি কি এখনই চলে যাচ্ছেন?’
জাহাঙ্গীর তাহার পা চৌকিতে তুলিয়া তো লইলই না, কোনোপ্রকার অসোয়াস্তির ভাবও তাহার ব্যবহারে ফুটিয়া উঠিল না। সহজ শান্ত কণ্ঠেই সে বলিয়া উঠিল, ‘হাঁ ভাই, আমি যাচ্ছি!’ একটু থামিয়া বলিল, ‘দুঃখের পসরা খোদা আমার মাথায় তুলে দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ করিনে ভাই, কিন্তু এর তাপ যে অন্যের গায়ে গিয়ে লাগে, এ দুঃখ রাখবার আর ঠাঁই নাই। আমি এসেছিলাম দুঃখ ভুলতে, কিন্তু সে দুঃখ যে এত বিপুল হয়ে উঠবে, সে দুঃখ যে অন্যেরও ঘর পোড়াবে – এ আমি জানতাম না।’
ভূণী একটু হাসিয়া শাড়ির আঁচলটায় পাক দিতে দিতে মুখ না তুলিয়াই বলিল, ‘সত্যই কি তাই? আপনাদের বড়োলোকের কি কোনোরকম দুঃখবোধ আছে?’
জাহাঙ্গীর আহত হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘ও কথা কেন বলছ ভাই? আমরা তোমার কথায় “বড়োলোক” হলেও মানুষ। অন্তত আমার হৃদয় নেই – এমন কিছুরই হয়তো পরিচয় দিইনি এখনও।’
ভূণী তেমনই ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ‘দেন নাই, পরে দেবেন! আচ্ছা, আপনি তো মহৎ হৃদয়বান এবং সেইজন্যই হয়তো তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন, স্বেচ্ছায় যাবেন, এতে কারই বা বলবার কী আছে। কিন্তু আমার কী হবে, বলতে পারেন?’ – আবার সে তাহার দুই আয়ত লোচনের অশ্রুর আবেদন জাহাঙ্গীরের পানে তুলিয়া ধরিল!
জাহাঙ্গীর একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমি বুঝেছি ভূণী, আজ কী সর্বনাশ হয়েছে! কিন্তু তুমিও কি এত বড়ো মিথ্যাটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করলে? পালিয়ে আমি যাচ্ছি না, আমি যাচ্ছি এই লজ্জার হাত এড়াতে। হারুণ আমার কত বড়ো বন্ধু, তা হয়তো তুমি জান না। আমার হাত দিয়েই তোমাদের এত বড়ো লাঞ্ছনা ছিল, তা আমি জানতাম না। কিন্তু তুমি তো জান, এতে আমাদের কারুরই অপরাধ নেই। অপরাধ শুধু আমার দুরদৃষ্টের!’
ভূণী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘দূরদৃষ্ট শুধু আপনার নয়, আমার। যে আগুন লাগায়, সে জানে না যার বুকে আগুন লাগল – তার কতটুকু পুড়ল! সে যাক, আপনি যেটাকে মিথ্যা বলছিলেন, আপনি বোধ হয় জানেন না, সেটার চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে নেই! আপনি বলবেন, মা আমার উন্মাদিনী। তবু তিনি আমার মা। আমরা নারী, আমরা হয়তো সকল কিছু অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। খোদার ইঙ্গিত না থাকলে এ অভাবনীয় দুর্ঘটনা আমার উন্মাদিনী মায়ের হাত দিয়ে ঘটত না!’ তাহার পর একটু থামিয়া সে শান্তকণ্ঠে বলিল, ‘আমি খুলেই বলি আপনাকে, মা যার হাতে আমায় সঁপে দিয়েছেন, তার চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে নেই!’