ভূণী তাহার জলভরা বড়ো বড়ো দুইটি চোখ তুলিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া থাকিল। সেই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা করুণা স্নেহ যেন উছলিয়া পড়িতেছিল।
হারুণের পিতা হঠাৎ হাসিয়া বলিলেন, ‘ওরে ভূণী, মোমি, মোবারক! তোরা যা, নতুন কাপড় পরে দেখা, কেমন মানাল! আর সালাম কর জাহাঙ্গীরকে। নতুন কাপড় পরে যে সালাম করতে হয়।’
মোমি কাপড়ের রাশ লইয়া ভূণীকে হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া গেল। মোবারক উঠিল না। শান্তভাবে বসিয়া রহিল। কাপড় জামা পাইয়া সে খুশি না বিরক্ত হইয়াছে, কিছুই বোঝা গেল না।
জাহাঙ্গীর একটু আশ্চর্য হইয়া বলিল, ‘মোবারক, অমন করে বসে যে। তোমার বুঝি কাপড় পছন্দ হল না? আচ্ছা দেখো তোমার জন্য কী এনেছি।’
বলিয়াই একটা ফুটবল বাহির করিয়া বলিল, ‘এই নাও। আজ বিকেলে সকলে মিলে ফুটবল খেলা যাবে, কেমন?’
মোবারক তাহার আনত চক্ষু তুলিয়া বিষণ্ণ মলিন দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আমি তো ফুটবল খেলিনে। ও সময় বাবাকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।’
জাহাঙ্গীরের মন দুঃখের ম্লানিমায় মলিন হইয়া উঠিল। সে কেমন যেন হাঁপাইয়া উঠিতে লাগিল। এত দুঃখের মাঝেও মানুষ বাঁচে কেমন করিয়া।
একটু আলাপ-সালাপ হইতেই মোমি তাহার সিল্কের জামাকাপড় পরিয়া আসিয়া জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘তোমরা সকলে ভিতরে এসো, নাস্তা করবে।’
ভিতরবাটীতে যাইতে যাইতে হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘গ্রিন রংটা তোকে বেড়ে মানিয়েছে তো রে মোমি! দেখেছ, মোমির আর্ট-জ্ঞান হয়েছে!’ বলিয়াই তাহার মাদ্রাজি ঢং-এ কাপড় পরিবার ধরনটার দিকে ইঙ্গিত করিল।
জাহাঙ্গীরও সে হাসিতে যোগ দিয়া বলিল, ‘সত্যই ওকে তো সুন্দর মানিয়েছে! কাপড় পরাটাও সুন্দর হয়েছে।’
মোমি জাহাঙ্গীরের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইতে যাইতে বলিল, ‘ও আল্লা! এ আমি বুঝি পরেছি? বুবু পরিয়ে দিয়েছে! বুবুকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! দেখবেন চলুন!’
জাহাঙ্গীর তাড়া দিয়া বলিল, ‘আবার আপনি? “তুমি” বলবে। আর “দাদা ভাই” – কেমন?’
মোমি বড়ো বড়ো দু-চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ও মা! কী হবে! এক দিনেই নাকি একটা মিনসেকে তুমি বলা যায়!’ সকলে হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিল। মোমি লজ্জা পাইয়া ছুটিয়া পলাইল।
ভিতরে গিয়া বসিতেই শোনা গেল, হারুণের মাতা জাগিয়া উঠিয়া ভূণীর সাজসজ্জা দেখিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, ‘ওরে মা, তুই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে আমি থাকব কী করে? আমার মিনার মতোই যে তোর চোখ মুখ। মা তুই শ্বশুরবাড়ি যাসনে! দামাদ মিয়াঁকে (জামাই) বল, সে ঘরজামাই থাকবে।’
জাহাঙ্গীর হাসিবে না কাঁদিবে ভাবিয়া পাইল না। হারুণ তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়া ভূণীকে বলিল , ‘ভূণী তুই বাইরে চলে আয় না!’ কিন্তু আর কিছু বলিবার আগেই ভূণীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘সত্যি ভূণী, এতে আর দোষ কী! আমিই যে চিনতে পারছিনে! মনে হচ্ছে বিয়ের কনে! কী সুন্দরই মানিয়েছে, দেখ দেখ।’ বলিয়াই আয়না লইয়া মুখের কাছে ধরিল।
ভূণী মুখ সরাইয়া লইয়া বলিল, ‘যাও! তা হলে সব খুলে ফেল বলছি! আমি কিছুতেই বাইরে যেতে পারব না। মা গো! কেন এ সব পরলুম!’
সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল!
জাহাঙ্গীর বাহির হইতে বলিল, ‘কী হচ্ছে হারুণ? তুমিও তো কম দুষ্টু নও!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘জাহাঙ্গীর! তোমার পাওনা সালামটা নিতে তুমিই ভিতরে এসো ভাই। ও বলেছে, এ রকম করে সেজে কিছুতেই বাইরে যাবে না। অর্থাৎ কিনা তোমার সামনে বার হবে না।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ভিতরে যাইতেই ভূণী একবার তাহার দিকে তাকাইয়াই তাহার মায়ের বিছানায় বসিয়া পড়িয়া বালিশে মুখ লুকাইল। জাহাঙ্গীর কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেল।
হারুণ ভূণীর মুখ জোর করিয়া তুলিয়া বলিল, ‘ওরে, একবার দেখা ভালো করে! আর, যে সালামের লোভে জাহাঙ্গীর বেচারা পা দুটোকে ভিতরবাড়ি পর্যন্ত টেনে আনলে, তার থেকেই বঞ্চিত করলি বেচারাকে? ওঠ, সালাম কর।’
কিন্তু উঠাইতে গিয়া হারুণ দেখিল, চোখের জলে ভূণীর মুখ ভাসিয়া গিয়াছে। সেই অশ্রুসিক্ত চোখ না মুছিয়া সে যেমন জাহাঙ্গীরকে সালাম করিতে যাইবে, অমনি এক অভাবনীয় কাণ্ড হইয়া গেল!
ভূণীর উন্মাদিনী মাতা এতক্ষণ উদাস নির্বিকার চক্ষে সমস্ত দেখিতেছিলেন। কিছু বুঝিতেছিলেন বলিয়া বোঝা যাইতেছিল না।
ভূণীর উন্মাদিনী মাতা এতক্ষণ উদাস নির্বিকার চক্ষে সমস্ত দেখিতেছিলেন। কিছু বুঝিতেছিলেন বলিয়া বোঝা যাইতেছিল না।
মাথার ওপর বজ্রপাত হইলেও বুঝি সকলে এমন স্তম্ভিত হইত না! হারুণ, জাহাঙ্গীর, ভূণী ওরফে তহমিনা সকলে যেন প্রস্তরীভূত হইয়া গিয়াছে।
হঠাৎ ভূণীর চোখের দিকে তাকাইয়া জাহাঙ্গীর কাঁপিয়া উঠিল। সে ধরিবার পূর্বেই ভূণী মূর্ছিতা হইয়া তাহার স্কন্ধে এলাইয়া পড়িল!
উঠানের আমগাছটায় বসিয়া একটা পাপিয়া পাখি ডাকিয়া উঠিল, চোখ গেল! চোখ গেল! উঁহু উঁহু চোখ গেল!
কুহেলিকা – ০৯
কালবৈশাখীর মেঘ এমনি করিয়াই দেখা দেয়। যেখানে দুঃখের বরষা, বজ্রপাতও হয় সেইখানেই। শান্ত নদীতীরে তারও চেয়ে শান্ত ভগ্নকুটির এমনি করিয়াই কোনো এক দুর্যোগের নিশীথে ভাসিয়া যায়!
দুঃখ যে কত বড়ো বন্ধুর রূপ ধরিয়া আসে, হারুণ তাহাই ভাবিতেছিল – একাকী দাওয়ায় বসিয়া।
অন্ধ পিতা এক মনে কলিকার পর কলিকা তামাক পোড়াইতে ছিলেন। অগ্নিগিরির গর্ভ হইতে যে ধূম্রপুঞ্জ নির্গত হয়, তাহার জ্বালাও বুঝি এত ভয়াবহ নয়। ঘর পোড়ে, সকলে দেখে, পোড়ারও অবধি আছে; কিন্তু মনে যদি একবার আগুন লাগে – তাহা কেহ দেখেও না, তাহার অন্তও নাই।