জাহাঙ্গীর চা খাইতে খাইতে বলিল, ‘ছেলেমানুষ এরা, নাস্তা তৈরি করতে দেরি হবে হারুণ, এসো দুটো বিস্কুট খাই।’ হারুণ আপত্তি করিল না। অন্যমনস্কভাবে বিস্কুট ও চা খাইতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, ‘এই মোমি! মোমি! আমার চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গেছে। তুমি এসে না দিলে আর এক কাপ চা কিছুতেই খাচ্ছিনে!’
মোমি বেড়ার পাশেই উঁকি মারিতেছিল। একটু বাঁকিয়া বাঁকিয়া কাছে আসিয়া চায়ের কাপটা জাহাঙ্গীরের হাতে দিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেই জাহাঙ্গীর খপ্ করিয়া তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘আমার সঙ্গে চা না খেলে আমি কিচ্ছু খাব না কিন্তু!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘খা না, এও তোর দাদাভাই!’ জাহাঙ্গীরকে বলিল, ‘ওকে তুমি চেন না জাহাঙ্গীর, ভয়ানক দুষ্টু। একটু আলাপ জমে গেলে তোমায় নাকাল করে ছাড়বে। কোনোদিন রাতে হয়তো তোমার কাছায় বেড়াল-বাচ্চা বেঁধে দেবে। ওর দুষ্টুমির জ্বালায় বাড়ির সকলে অস্থির!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘সত্যি! তবে রে দুষ্টু, কিছুতেই চা না খাইয়ে ছাড়ছি না তা হলে!’….
একটু পরেই দেখা গেল, মোমি কলিকাতা সম্বন্ধে তাহার অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা লইয়া প্রশ্ন করিয়া জাহাঙ্গীরকে চা খাইবার অবসর পর্যন্ত দিতেছে না।
জাহাঙ্গীরও অকুতোভয়ে বলিয়া যাইতেছিল, ‘কলকাতার লোকগুলোর দাড়ি হয় না, সেখানে কাপড় ময়লা হয় না, চুলের তেড়ি ভাঙে না। সেখানে মানুষ পায়ে হাঁটে না, তারা কোমর পর্যন্ত মানুষ, তার পর চারটে চাকা। তাদের চারটে চারটে চোখ। পুরুষের গোঁফ দাড়ি হয় না। মেয়েরা ছেলেদের মতো করে চুল কাটে; ছেলেরা মেয়েদের মতো চুল বড়ো রাখে। পুরুষে রান্না করে, মেয়েরা থিয়েটার দেখে, নাচে। ছেলেরা বাঁদর হয়ে বাবাকে ভল্লুক করে তার পিঠে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, মেয়েরা ডুগডুগি বাজায়!’
এমন সময় হারুণের ছোটো ভাইটি তাহার অন্ধ পিতার হাত ধরিয়া বৈঠকখানায় লইয়া আসিল।
জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাঁহার পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘কাল আর আপনার সাথে ভালো করে আলাপ করতে পারিনি। আমরা চা খাচ্ছি, একটু দেব? খাবেন?’
হারুণের পিতা খুশি হইয়া বলিলেন, ‘দাও বাবা, দেখি ভূণী কেমন চা করলে! ভূণী চা করতে পেরেছে তো? আমরা তো কেউ খাইনে। আমিও এক কালে প্রায় তোমার মতো চা-খোর ছিলাম বাবা।’ বলিয়াই গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কোনো সুখময় অতীতকে তাঁহার অন্ধ চক্ষু দিয়া যেন দেখিবার চেষ্টা করিলেন!
জাহাঙ্গীরের মন করুণায় ভিজিয়া উঠিল। মুখের চা বিস্বাদ হইয়া উঠিল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়াই হারুণের পিতা বলিয়া উঠিলেন, ‘সত্যিই, ভূণী চমৎকার চা করেছে তো রে! ভূণী! ও ভূণী!’
ভূণী সলজ্জভাবে দরজার পাশে আসিয়া অধোমুখে আঙুলে আঁচলের প্রান্ত লইয়া জড়াইতে লাগিল।
হারুণ বলিল, ‘ওই ভূণী এসেছে। কিছু বলছিলে তাকে?’
পিতা হঠাৎ কেমন যেন বিষাদের সুরে বলিলেন, ‘না, কিছু না। মোবারক কোথায় গেলি?’
মোবারক হারুণের ছোটো ভাই। ছেলেটি অদ্ভুত – শান্ত ধীর প্রকৃতির। এই বয়সেই যেন বিশ্বের বিষণ্ণতা আসিয়া তাহাকে ছাইয়া ফেলিয়াছে। মুখে চোখে আনন্দের এতটুকু ক্ষীণ রেখাটিও নাই। বর্ণ ফ্যাকাশে সাদা, লিকলিকে, পাঁজরের হাড় কটি গোনা যায়।
মোবারক চা খাইতেছিল। পিতার ডাকে চকিত হইয়া শান্তস্বরে বলিল, ‘এই যে চা খাচ্ছি!’
এরই মাঝে জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আমরা সকলে চা খাচ্ছি, ভূণী যদি না খাও তাহলে…’
জাহাঙ্গীর আর কিছু বলিবার আগেই হারুণের পিতা বলিয়া উঠিলেন, ‘আয় ভূণী, তোর মা তো এখনও ঘুমুচ্ছেন, তুইও খা না একটু! এমন সোনার ছেলের কাছে কি লজ্জা করতে আছে? মনে কর না, ও তোর মিনা ভাই!’ – বলিয়াই পিতা চায়ের কাপ মাটিতে রাখিয়া পাঁজরফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন!
ভূণী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া নিজের হাতে চা করিয়া খাইতে খাইতে বলিল, ‘বাবা তুমি চা খাও, এই আমি খাচ্ছি।’
জাহাঙ্গীর দেখিল, ভূণীর দুই আয়ত চক্ষু জলে টইটুম্বর হইয়া উঠিয়াছে। সে আর এ দৃশ্য সহিতে পারিতেছিল না। হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, ‘মোমি এসো তো ভাই, আমরা ওই তোরঙ্গটা খুলি। ওতে কলকাতার বড়ো বড়ো বাঁদর আছে, দেখবে?’
মোমি চিৎকার করিয়া বলিল, ‘ওরে বাপরে! ও কামড়ে দেবে, আমি কুছুতেই খুলতে পারব না!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া নিজের তোরঙ্গটা খুলিয়া একরাশ কাপড়জামা বাহির করিয়া হারুণের পিতাকে বলিল, ‘আমি এদের জন্য কিছু কাপড়জামা এনেছি, আপনি আদেশ না দিলে ওরা হয়তো নেবে না। ওরা তো আমারও ভাই-বোন!’ একটু থামিয়া আবার বলিল, আমার একটিও ছোটো ভাইবোন নেই বলে আমার এত দুঃখ হয়। তাই বন্ধুদের ভাইবোন নিয়ে সে সাধ মেটাই। ভাই মোমি, এসব নেবে তো ? না নিলে কিন্তু আজই চলে যাব আমি।’
হারুণ একটু উচ্চকণ্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘এসব আবার করেছ কী? এসব দামি কাপড় কিনতে তোমার তিন চারশো টাকার কম পড়েনি যে! এসব কখন করলে বলো তো! মিষ্টি সন্দেশ তো এনেছ বাগবাজার আর শিউড়ি উজাড় করে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া একটু নিম্নকণ্ঠে বলিল, ‘এই স্টুপিড, তুমি চুপ করো। সরকার কা মাল, দরিয়া মে ডাল! জমিদারির এত টাকা নিয়ে কী করব? পাপের ধন পরাচিত্তিতে যাক! আমার ভাইবোন থাকলে খরচ করতাম না?’
হারুণের পিতা অত্যধিক খুশি হইয়া একটু ভারীকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘এর পরে আর কী বলব বাবা! খোদা তোমাকে সহি-সালামতে রাখুন, হায়াতদারাজ করুন! তুমি সত্যই আমার ছেলের চেয়ে বড়ো। যে দানে অহংকার নেই, তাকে কি উপেক্ষা করতে আছে?’