ভূণী যাইতেছিল, আর তাহার যাওয়া হইল না। সে লজ্জার রাঙা হইয়া বলিল, ‘আমি যেতে পারব না, মোমিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ভূণীর ছোটো বোন মোমি আজও দ্বাদশীর চাঁদ। ভূণীর মতো আজও সে ষোলো কলায় পূর্ণ হইয়া ওঠে নাই। সে কাছেই দাঁড়াইয়া সব শুনিতেছিল এবং তাহার চোখে-মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখিয়া বেশ বোঝা যাইতেছিল যে, সে এই ব্যাপারের রহস্যটুকু রীতিমতো উপভোগ করিতেছে।
এ দেশের সম্ভ্রান্ত মুসলমান ঘরেও ‘দিদি’-কে পূর্ববঙ্গের মতো ‘আপা’ না বলিয়া ‘বুবু’ বলিয়াই ডাকে।
তাহার বুবুর কথা শুনিয়া মোমি ঝংকার দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ইস! আমি যেতে গেছি আর কী! তোমায় ডেকেছেন, তুমি যাও।’
ভূণী কোপ প্রকাশ করিয়া বলিল, ‘এই মোমি! যা তা বললে তোমার পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙব কিন্তু!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘নে আর ঝগড়া করতে হবে না। চল, আমরা তিন জনেই যাই। আমি বসে থাকব, তোরা চা করবি।
মোমি খুশি হইয়া উঠিল। ভূণী কিন্তু একটু সলাজ সংকোচেই গেল।
বাহির বাড়িতে যাইয়া ভূণী পুকুরের দিকে চাহিতেই জাহাঙ্গীরের সাথে চোখাচোখি হইয়া গেল। জাহাঙ্গীর চোখ নামাইয়া লইল। ভূণী কিন্তু ইচ্ছা করিয়াও চোখ নামাইতে পারিল না। রাত্রিবেলায় বনহরিণীর চোখে শিকারির ফ্লাশ-লাইটের জ্যোতিঃধারা গিয়া পড়িলে সে যেমন মুগ্ধবিস্ময়ে সেই আলো হইতে চোখ ফিরাইয়া লইতে পারে না, তেমনি করিয়া ভূণী জাহাঙ্গীরের অনাবৃত সুঠাম সুডৌল বলিষ্ঠ দেহের পানে চাহিয়া রহিল। ইচ্ছা করিয়াও চক্ষু ফিরাইতে পারিল না। ইহা যে লজ্জার, ইহা যে অন্যায়, ইহা সে ভাবিবার অবকাশ পর্যন্ত যেন পাইল না।
জাহাঙ্গীরের বিরাট বক্ষ স্নানের শ্রমে ঘন ঘন আন্দোলিত হইতেছিল, শরীরের সমস্ত মাংসপেশী পরিপূর্ণভাবে ফুলিয়া উঠিয়াছিল। সে এইবার ঘাটে পিছন ফিরিয়া বসিয়া সাবান মাখিতে মাখিতে স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিল, তাহার পৃষ্ঠে একজোড়া খরদৃষ্টির উষ্ণতা আসিয়া লাগিতেছে!
জাহাঙ্গীর এইখানে একটু লাজুক। সে মহিলাদের সঙ্গে অতিমাত্রায় মিশিতে পারে, মিশিতে চায়ও। কিন্তু কোনো মেয়ে একটু খরদৃষ্টিতে চাহিলে সে আর চোখ তুলিতে পারে না। মেয়েদের সে যেমন পছন্দ করে, তেমনই ভয়ও করে। অশ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়।
সে একবার হাজারিবাগের জঙ্গলে শিকারে গিয়াছিল। একদিন রাত্রে সে ফ্লাশ-লাইট দিয়া শিকার খুঁজিতেছিল। হঠাৎ একটা হরিণের চোখে সেই লাইট পড়ায় হরিণ এমন করিয়া সুন্দর ভীতির চাহনি দিয়া তাহার দিকে চাহিয়াছিল, যে, সে আর তাহাকে গুলি করিতে পারে নাই। আজও ইচ্ছা করিয়াই পিছন ফিরিয়া ঘাটে বসিয়া সাবান মাখিতে লাগিল। যে হরিণী তাহার দিকে এখনই এমনি করিয়া তাকাইয়াছিল, জাহাঙ্গীর জানে, ইচ্ছা করিলেই তাহাকে হত্যা করিতে পারে, তবু সে বিরত হইল। তাহার কেমন যেন দয়া হয় উহাদের দেখিলেই! উহাদের চোখ জাদু জানে। উহাকে এড়াইয়া চলাই ভালো – জাদুকরিকে হত্যা করায় পৌরুষ নাই।
নারী – তাহাকে সে যেমন অশ্রদ্ধা করে তেমনই ভালোও বাসে – উহারা সুন্দর জাদুকরি।… জাহাঙ্গীরের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠে, দেহের মাংসপেশীসমূহ প্রস্তরকঠিন হইয়া উঠে। একবার মনে করে, ওই সুন্দর চোখের সুন্দর জীবগুলোকে নির্মম হস্তে সে হত্যা করিতে পারে! উহাদের চোখ সুন্দর, উহাদের মন ছলনায় কুটিল!…
জাহাঙ্গীর যখন স্নান সারিয়া উঠিয়া আসিল, তখন চা হইয়া গিয়াছে।
ভূণী ভিতরে চলিয়া যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইতেই দেখিল, সদ্যস্নাত জাহাঙ্গীর তাহার গ্রিক ভাস্করের নির্মিত মর্মরমূর্তির মতো অনাবৃত দেহ লইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
আদিম মানব প্রথম অরুণোদয় দেখিয়া যেমন বিস্ময়ান্বিত চোখে জবাকুসুমসংকাশ তরুণ অরুণের পানে চাহিয়া দেখিয়াছিল, এ তেমনই দৃষ্টি।
জাহাঙ্গীর তাহাকে অপ্রতিভ হইবার অবসর না দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘দাঁড়াও ভাই ভূণী, পালিয়ে যেয়ো না। চা-টা যখন তৈরিই করলে, তখন না খাইয়ে আর যেয়ো না। কেমন?’ বলিয়াই মোমির দিকে চাহিয়া বলিল, ‘তোমার এখনও লজ্জা হওয়ার মতো বয়স হয়নি, তুমি কেন অমন জড়-পুঁটুলি হয়ে বসে আছ ভাই?’
মোমি সত্যিই এতক্ষণ বিয়ের কনেটির মতো কাপড় ঢাকা দিয়া এক কোণে বসিয়াছিল, এইবার খুক খুক করিয়া হাসিতে লাগিল এবং একটু পরেই ঘোমটা খুলিয়া হাসিতে হাসিতে দৌড়িয়া ভিতরে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর কাপড় বদলাইয়া চৌকাঠটার উপর বসিয়া ভূণীর দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল, ‘দাও ভাই, চা-টা দাও!’
ভূণীকে কে যেন মন্ত্র দিয়া বশ করিয়াছে।
মন্ত্রাহত সাপিনির মতো সে না পারিল পালাইতে, না পারিল ফণা তুলিতে।
সে আস্তে আস্তে এক কাপ চা হারুণকে দিয়া দ্বিতীয় কাপটা কাঁপিতে কাঁপিতে জাহাঙ্গীরের হাতে দিল। আর একটু হইলেই পেয়ালাটা পড়িয়া গিয়াছিল আর কী! জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি পেয়ালাটা ধরিতে গিয়া ভূণীর কয়েকটা আঙুল ধরিয়া ফেলিল। লজ্জা ঢাকিবার জন্য তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়া জাহাঙ্গীর চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাঃ বাঃ কী চমৎকার চা-ই হয়েছে ভূণী!’
ভূণী ততক্ষণে লজ্জায় ঘামিয়া লাল হইয়া উঠিতেছিল। আর একটু থাকিলেই হয়তো সে মূর্ছিত হইয়া পড়িত। কিন্তু তাহাকে আর থাকিতে হইল না। তাহার অন্ধ পিতা উঠিয়া তাহাকে বাড়ির ভিতর হইতে ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিলেন। সে তাড়াতাড়ি পালাইয়া বাঁচিল।
হারুণ এতক্ষণে কী যেন ভাবিতেছিল। তাহার আদরের বোনের এই ভাবান্তর সে লক্ষ করিয়াছিল। ইহা লইয়া সে আপন মনে কত কী আকাশ-কুসুমের সৃষ্টি করিতেছিল। কত সুখের স্বপন, কত ভবিষ্যতের রাঙা উৎসবের রাঙা দিন, আরও কত কী!