হারুণ তাহার মাতাকে লইয়া বিব্রত হইয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর আর থাকিতে না পারিয়া আগাইয়া আসিয়া পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, ‘মা ভিতরে চলুন!’
মাতা তাহার দিকে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখে চাহিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘মিনা এসেছিস? অ্যাঁ? তোর সাইকেল কই? আমার পালকি কই?’
হারুণ ও জাহাঙ্গীর ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে ঘরে আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিল। জাহাঙ্গীর চলিয়া আসিতেছিল, কিন্তু মাতা ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘মিনা চলে গেলি? ও খোকা? মিনাকে ধর ধর! পালাল পালাল!’
জাহাঙ্গীর চলিয়া আসিতেছিল দেখিয়া হারুণের দুই বোন আসিয়া মাতাকে ধরিয়াছিল, কিন্তু মায়ের এই ক্রন্দনে জাহাঙ্গীর ফিরিয়া আসিতেই তাহারা আবার উঠিয়া পলাইল। হারুণ একটু রাগিয়া বলিয়া উঠিল, ‘এ-সময় অত বিবি হতে হবে না তোদের! এ আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর। আমাকে দেখে যদি লজ্জা না করিস তো জাহাঙ্গীরকেও লজ্জা করবার কিছু নেই।’
এইবার তাহারা কোনোরকমে জড়সড় হইয়া মায়ের কাছে আসিয়া বসিল। হারুণ কী ইঙ্গিত করিতেই তাহারা দুই বোন জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিল। জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘কী দোওয়া করব? রাজরানি হও না অন্য কিছু?’ বলিয়াই দেখিল ঘোমটার আড়াল হইতে এক জোড়া উজ্জ্বল সুন্দর চক্ষু ভোরের তারার মতো তাহার দিকে চাহিয়া আছে। জাহাঙ্গীরের বুক কাঁপিয়া উঠিল, সে চোখ ফিরাইয়া লইল! মাতা তখন অনেকটা শান্ত হইয়াছেন। জাহাঙ্গীরের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে তিনি মাঝে মাঝে অস্ফুটস্বরে বলিতেছিলেন, ‘মিনা! বাবা আমার! তুই আর যাসনে। আমি সাইকেল কিনে দেব!’
কুহেলিকা – ০৮
পরদিন অসহ্য গরমে অতি প্রত্যুষেই জাহাঙ্গীরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে উঠিয়াই বাহিরবাটী হইতে হারুণকে চিৎকার করিয়া ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়া দিল। হারুণ ঘুম-বিজড়িত চক্ষে উঠিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী হয়েছে জাহাঙ্গীর? কিছু হয়েছে নাকি?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আরে তৌবা, তোমাদের দেশটা দেখছি জ্যৈষ্ঠি বুড়ির একেবারে উনোনের পাশ! কাল রাত্তির থেকে সকাল পর্যন্ত আমার অন্তত তিন কলসি ঘাম ঝরেছে! বাপ!’
হারুণ হাসিয়া ভালো করিয়া কাছাটা গুঁজিতে গুঁজিতে বলিল, ‘আমি তো সেই জন্যেই কাল ভিতরে গিয়ে শুতে চাইনি। তোমার কাছে থাকলে অন্তত খানিকক্ষণ পাখা করতে পারতাম।’ বলিতে বলিতে আবার বসিয়া পড়িল!
জাহাঙ্গীর হাসিয়া উঠিল। প্রভাতের আকাশের মতো খোলা প্রাণের হাসি, সুন্দর উজ্জ্বল! বলিল, ‘বন্ধু তোমার ব্যাক-টাইটা আগে ভালো করে এঁটে নাও গিয়ে! আমি বরং ততক্ষণ একটু সাঁতার কাটি তোমাদের ওই এঁদো পুকুরটাতে!’ – বলিয়াই জাহাঙ্গীর তাহার বেতের বাক্সটা খুলিয়া চায়ের সরঞ্জাম বাহির করিয়া স্টোভটা জ্বালাইয়া চায়ের জল চড়াইয়া দিয়া তোয়ালে সাবান লইয়া পুকুরে ঝাঁপাইয়া পড়িল। হারুণ সস্মিত আননে তাহার সাঁতার-কাটা দেখিতে লাগিল।
সাঁতার কাটিতে কাটিতে জাহাঙ্গীর বলিল, ‘হারুণ, পানিটা গরম হয়ে গেলে তোমার বোনকে নিয়ে একটু চা-টা তৈরি করে নিয়ো ভাই। চা দুধ চিনি সব ওই বাক্সে আছে। দোহাই তুমি তৈরি করতে যেয়ো না যেন! সব ভণ্ডুল করবে তা হলে!’ – বলিয়াই জাহাঙ্গীর এক ডুবে মাঝপুকুর হইতে ঘাটে আসিয়া চুলগুলো পিছন দিকে সরাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘হারুণ, তখন বলছিলে, রাত্রে আমার কাছে থাকলে খানিকক্ষণ পাখা করতে পারতে, না? তা হলে যেটুকু ঘুম আমার হয়েছিল, তা-ও হত না! বাপ! পাশে শুয়ে একটা মদ্দ মিনশে পাখা করছে দেখলে ঘুম বেচারি ঘোমটা টেনে তিন লাফে ঘর ছেড়ে পালাত। পুরুষের সেবা – উঃ সে কী ভয়ানক! ভাদ্দর বউকে ভাসুর সেবা করতে এলে তার যেমন অবস্থা হয়, তেমনই আর কী।’
হারুণ এইবার একটু জোরেই হাসিয়া ফেলিল। বলিল, ‘দোহাই ভাই, ওই দুঃখে তুমি জলে ডুবো না যেন! আমি কোনোদিনই তোমার সেবা করতে যাচ্ছিনে। চা-টা ভূণীকেই করতে বলছি। তবে সেও আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ নয়।’
তাহার কথার অর্থ অনুরূপ দাঁড়াইল দেখিয়া জাহাঙ্গীর একটু লজ্জিত হইয়া উঠিল। তবে সে তুখোড় ছেলে, সহজে মুষড়াইয়া যায় না। বলিল, ‘তা হোক গে, মা খাবার না রেঁধে যদি বাবা ও কর্মটা করতেন, তা হলে এর অনেকটা স্বাদ কমে যেত হে!’ বলিয়াই জাহাঙ্গীর আবার সাঁতার কাটিতে আরম্ভ করিল।
হারুণ বাড়িতে গেয়ে তাহার বোন ‘ভূণী’কে হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘ওরে ভূণী, জাহাঙ্গীর স্টোভে চা চড়িয়ে নাইতে গেছে। তুই চা-টা একটু তৈরি করে রাখ গিয়ে। চা, দুধ, চিনি, কাপ, চামচ সব ওইখানেই আছে। ওর ওই একটা দোষ, কোথাও যাবার সময় চায়ের সরঞ্জাম সাথে না নিয়ে যায় না।’
ভূণী হারুণের বোন দুটির মধ্যে বড়ো। বয়স পনেরো পার হইয়া গিয়াছে। দেখিতে কিন্তু আরও একটু বেশি বয়সের বলিয়াই মনে হয়। চমৎকার জ্বলজ্বলে চোখমুখ। সমস্ত শরীরে বুদ্ধির প্রখর দীপ্ত জ্যোতি যেন ঠিকরিয়া পড়িতেছে। সে তাহার ভ্রাতার আদেশে বাহিরবাটীতে যাইতে একটু ইতস্তত করিল। ওর ঘর হইতে পুকুরটা একেবারে সামনে। তাছাড়া সে ভালো চা করিতেও জানে না। বাড়িতে ও পাট একেবারেই নাই।
হারুণ বুঝিতে পারিয়াই একটু দুষ্টুমি করিয়া বলিল, ‘ওরে ভূণী, জাহাঙ্গীর বলেছে, তুই – এই তোরা কেউ চা তৈরি করে না দিলে ও কিছুতেই খাবে না। পুরুষ লোকের সেবা আর রান্না জিনিসের উপর ওর ভয়ানক আক্রোশ! আমি চা করলে ও হয়তো তা আমার মুণ্ডুতেই ঢেলে দেবে।’