পুকুরপাড়ের একটা অর্জুন গাছের ডালে যে সুন্দর নীল পাখিটা বসিয়াছিল, জাহাঙ্গীর তাহারই দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়াছিল। এত সুন্দর পাখি সে আর কখনও দেখে নাই। সে উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘না হারুণ তোমাদের দেশে মাসখানেক থাকলে আমি একেবারে কবি বনে যাব! এত দেশ থাকতে কেন তোমাদেরই দেশে জয়দেব-চণ্ডীদাস জন্ম নেন, তা অনেকটা বুঝছি।’
সে আবার শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘না ভাই। এ ধুলো আর ধুচ্ছিনে পথে। বাংলার পথের ধুলো, আমার জন্মভূমির বেদনাতুর পথিকের পায়ের ধুলো – ও শুধু বুক পর্যন্ত কেন মাথা পর্যন্ত উঠলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম! পবিত্র ধুলো কি এত তাড়াতাড়ি মুছতে আছে ভাই?’
বলিয়াই দিগন্তপ্রসারী মাঠের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘দেখো কবি, আমি কবিতা-টবিতা ভালো বুঝিনে! গোঁয়ার-গোবিন্দ লোক আমি। কিন্তু আমার আজ এই মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, এর চেয়ে ভালো কবিতা তোমাদের কোনো কবিই লিখে যেতে পারেননি। এই মাঠের আলোর ছন্দোবদ্ধ লাইনের বন্ধনে কখনও সবুজ কখনও সোনার রঙে যে কবিতা লেখা হয়, তার কি তুলনা আছে! ওই কৃষকের লাঙলের চেয়ে কি তোমাদের কালিভরা লেখনী বেশি ফুলের ফসল ফলাতে পারে? ওই মাঠের খাতায় নিরক্ষর কবির সৃষ্টির কাছে তোমাদের জগতের সবচেয়ে বড়ো কবি কি তাঁর পুথির বোঝা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন?
হারুণ দুই চক্ষে বিস্ময় ভরিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে চাহিয়া রহিল। এই কি সেই কঠোর বাস্তবব্রতী বস্তুবিশ্বের পূজারি জাহাঙ্গীর? কিন্তু ইহা লইয়া সে প্রশ্নও করিল না। উহাকে সে কোনো দিনই বুঝিতে পারে নাই, আজও পারিল না। সে অন্যমনস্কভাবে বলিল, সত্যি ভাই, এরাই সত্যিকার ফুলের কবি, আমরা কথার কবি। আমরা যখন ঘরের আঁধার কোণে বসে মাকড়সার মতো কথার ঊর্ণা বুনি এরা তখন সারা দেশকে ফুলের ফসলের মতো সুন্দর রঙিন করে তোলে! এদের শ্রমেই তো ধরণির এত ঐশ্বর্য-সম্ভার, এত রূপ, এত যৌবন!’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘তাই ভাবছি হারুণ, এত বিপুল শক্তি এত বিরাট প্রাণ নিয়েও এরা পড়ে আছে কোথায়। এরা যেন উদাসীন আত্মভোলার দল, সকলের জন্য সুখ সৃষ্টি করে নিজে ভাসে দুঃখের অথই পাথারে। এরা শুধু কবি নয় হারুণ, এরা মানুষ! এরা সর্বত্যাগী তপস্বী দরবেশ! এরা নমস্য।’
জাহাঙ্গীর দুই হাত তুলিয়া সসম্ভ্রমে মস্তকে ঠেকাইল। হারুণের চোখ শ্রদ্ধায় বেদনায় বাষ্পাতুর হইয়া উঠিল। এই কি সেই প্রভাতের হত্যাকারীর মতো ভয়াবহ জাহাঙ্গীর!
কুলি দুইজন এইবার উঠিবার জন্য তাড়া দিতে লাগিল। জাহাঙ্গীর উঠিয়া কুলির মাথা হইতে হারুণের বোঁচকা ও নিজের বেতের বাক্সটা হাতে লইয়া বলিল, ‘চল’। হারুণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘অন্যায় করেছি বন্ধু এক জন মানুষের বোঝা আমারই মতো আরেক জন মানুষের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমরা এসে পড়েছি। অর্থ দিয়ে কি মানুষের হাতের সেবার, তার শ্রমের প্রতিদান দেওয়া যায়? এখন এই রাস্তাটুকু ওদের সুদ্ধ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেলেও এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।… মানুষের একটা নূতন বেদনার দিক দেখতে পেলাম আজ। এতদিন বইয়ের পাতায় যাকে দেখেছি, আজ চোখের পাতায় তার দেখা পেলাম।…’
হারুণ কিছুই বুঝিতে পারিল না। জাহাঙ্গীরের তাহার সাথে আসা হইতে আরম্ভ করিয়া এই রাস্তায় চলা পর্যন্ত যেসব ব্যাপার সে দেখিল, যাহা কিছু শুনিল, তাহাতে তাহার মধ্যে তাহার সমস্ত চিন্তা সমস্ত কিছু যেন একটা তাল পাকাইয়া গিয়াছে। সে নিঃশব্দে অভিভূতের মতো পথ চলিতে লাগিল।
গ্রামে প্রবেশ করিয়া দুই একটি বাড়ি পরেই তাহাদের জীর্ণ খোড়ো ঘর। হারুণ ঘরের দুয়ারে আসিয়া পঁহুছিতেই তাহার দুইটি বোন ছুটিয়া আসিয়া তাহার পায়ের ধুলা লইল। তাহারা তাহাদের আনন্দের আতিশয্যে হারুণের পিছনে জাহাঙ্গীরকে দেখিতে পায় নাই। হঠাৎ তাহার দিকে চোখ পড়িতেই তাহারা জিভ কাটিয়া ছুটিয়া পলাইল।
হারুণ বাহিরের ঘরের দরজা খুলিয়া দিয়া ভাঙা তক্তপোশে বিছানা পাতিয়া দিবার উদ্যোগ করিতেই জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দোহাই হারুণ, তোমার ভদ্রতা রাখো! তুমি নিরতিশয় অতিথিপরায়ণ, মেনে নিলাম। তুমি আগে তোমার বাবা-মা ভাই-বোনের সাথে দেখাশুনা করে এসো।’
হারুণ হাসিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল। এমন সময় তাহার মা আলুথালুবেশে চিৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘খোকা এসেছিস? খোকা এসেছিস? আমার জন্যে পালকি এনেছিস ? মিনার জন্য সাইকেল এনেছিস? মিনা যাবে সাইকেলে, আমি যাব পালকিতে – হুই গোরস্থানে! মিনার সাইকেল! মিনা!’ বলিয়াই আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
হারুণের জননী উন্মাদিনী। হারুণের আর একটি ভাই ছিল, হারুণের চেয়ে দু-বছরের বড়ো, ডাক নাম ছিল তার – মিনা। তেরো বৎসর বয়সে সে মারা যায়। তাহার পরেই তাহার মাতা পাগল হইয়া যান। তাহার পিতারও কিছুদিন আগে বসন্ত হয়, তিনি কোনোরকমে বাঁচিয়া যান, কিন্তু দুইটি চক্ষু চিরজন্মের মতো অন্ধ হইয়া যায়।
মৃত্যুর সময় মিনা বিকারগ্রস্ত অবস্থায় কেবলই কাঁদিয়াছিল, ‘আমি সাইকেল চড়ব, আমায় সাইকেল কিনে দাও!’ দুর্ভাগিনি মাতা পাগল হইয়া গেলেও ‘মিনা’ আর ‘সাইকেল’ এই দুটি কথা ভুলিতে পারেন নাই।
হারুণের দুইটি বোন ও ছোটো ভাইটির এই পাগলিনি মাতা ও অন্ধ পিতাকে লইয়া যে কী করিয়া দিন কাটে, তাহা ভাবিয়া জাহাঙ্গীরের শরীরের রক্ত হিম হইয়া যাইতে লাগিল। অথচ হারুণ একদিনও তাহার এই অসহায় অবস্থার কথা তাহার কাছে বলে নাই।