আজ তাহার প্রথম মনে হইল, জাহাঙ্গীর শুধু তাহার চেয়ে দুঃখীই নয়, – তাহার চেয়েও সে দরিদ্র, সে সর্বহারা!
কুহেলিকা – ০৭
ভোর না হইতেই একটা দুরন্ত কোকিলের ডাকে হারুণের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সারারাত্রি সে নেশাখোরের মতো ঘুমাইয়াছে, পাশ পর্যন্ত ফিরে নাই। কত সুখের, কত বেদনার যেসব স্বপন সে সারারাত্রি ভরিয়া দেখিয়াছে, তাহার আবেশ যেন তখনও তাহার আঁখিপাতায় জড়াইয়া আছে।
উন্মত্ত যৌবনের অভূতপূর্ব সুখের পীড়ায় তাহার সারা দেহমন তখন চড়া সুরে বাঁধা বীণার মতো টনটন করিতেছিল। তাহার রক্তে রক্তে মহুয়া নেশার মতো কী যেন একটা পুলক রিনিরিনি করিয়া ফিরিতেছিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া সে তাহার কবিতার ডালি সাজায় সেই হাওয়া-পরিকে আজ সে চায় না, আজ এই কোকিলডাকা দক্ষিণা-বাতাসবহা গ্রীষ্ম প্রভাতে সে চায় সেই মাটির মানবীকে – যাহার মধ্যে তাহার সমস্ত কবিতা নিঃশেষ হইয়া যাইবে।…
হঠাৎ তাহার স্বপ্ন টুটিয়া গেল। জাহাঙ্গীর তখনও সামনে পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে! সে জাহাঙ্গীরের নিকটে গিয়া দেখিল, তাহার দুই চক্ষু জবাসংকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, নিশিশেষের পাণ্ডুর গ্যাসের আলো পড়িয়া তাহার মুখ ভীষণ করুণ দেখাইতেছিল। অত্যন্ত প্রিয়জনকে স্বহস্তে হত্যা করিবার পর হত্যাকারীর মুখচোখ যেমন হয় তেমনি।
হারুণের কবি-মন হেরেমের কিশোরীর মতো, বন-মৃগীর মতো ভীরু, স্পর্শালু। কঠিন রূঢ় কোনো কিছুর স্পর্শ সে সহিতে পারে না; মারামারি তো দূরের কথা, কোথাও কলহ দেখিলেও সে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে, তার সকল দেহমন বিস্বাদ ভয় ও হতাশায় একেবারে এলাইয়া পড়ে! সে সকল অন্তর দিয়া প্রার্থনা করে, জিজ্ঞাসা করি বিধাতাকে, কেন এই কলহ, কেন এই কুৎসিত সংগ্রাম, কেন এই অশান্তি! কবে মানুষ, মানুষ হইবে! খোদা, ইহাদের শান্তি দাও! ইহারা তোমার সুন্দর সৃষ্টিকে ভয়াবহ করিয়া তুলিল! তোমার ধরণির পুষ্পকুঞ্জ মত্ত রাবণের মতো ইহারা ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল।…
আজও সে জাহাঙ্গীরের এই ভীষণ মূর্তি দেখিয়া ভীত শুষ্ককণ্ঠে কোনোরকমে শুধু বলিতে পারিল, ‘জাহাঙ্গীর!’ সে আর কিছু বলিতে পারিল না। সমস্ত শরীর অজানা শঙ্কায় বেতসপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। জাহাঙ্গীর চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘একী! হারুণ?’ বলিয়াই চারদিকে চাহিয়া লইয়া সলজ্জ অপ্রতিভ স্বরে বলিল, ‘ভোর হয়ে গেছে বুঝি? খুব ভয় পেয়ে গেছ তুমি, না? ও কিছু নয়, অমন আমার প্রায়ই হয়!’
হারুণ অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি সারা রাত জেগে পায়চারি করেছ? আর আমি ষাঁড়ের মতন পড়ে পড়ে আরাম করে ঘুমিয়েছি?’
জাহাঙ্গীর বাম করে হারুণের কণ্ঠ মালার মতো জড়াইয়া ধরিয়া শান্তস্বরে বলিল, ‘তাতে হয়েছে কী ভাই! চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি এই সময়। বেশ ঠান্ডায় ঠান্ডায় যাওয়া যাবে। কেমন? তুমি সব গুছোও, আমি স্টেশনের যে দুটো কুলিকে ঠিক করে রেখেছি আমাদের এই বোঁচকা-পুটুলি নিয়ে যাবার জন্যে, ওদের খুঁজে বের করি ততক্ষণ।’
জাহাঙ্গীর চলিয়া গেল। হারুণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিছানাপত্র গুছাইতে গুছাইতে ভাবিতে লাগিল জাহাঙ্গীরের এই অপূর্ব আত্মসংযমের মাধুর্য। হত্যাকারীর মতো ভীষণ রুক্ষ মুখ কেমন করিয়া চক্ষের পলকে এমন সুন্দর সহজ হাসিতে ভরিয়া উঠিতে পারে, তাহা সে কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিল না। সহসা তাহার মনে হইল, এই বেদনার এই দুঃখের বন্ধু জাহাঙ্গীর কাহাকেও করিতে চায় না – যত বড়ো অন্তরঙ্গ বন্ধু হোক সে, তাহাকেও জাহাঙ্গীর তার গোপন বেদনা-মন্দিরের সন্ধান বলিবে না। এইখানে সে একা – একেবারে একা! অমা-নিশীথিনীর অন্ধকারও সে রহস্যের সে বেদনার অন্ধকার পথে পথ না পাইয়া ফিরিয়া আসিবে!…
জাহাঙ্গীর যে এমন মিলিটারি-স্টাইলে এত জোরে – এতটা পথ হাঁটিয়া আসিতে পারিবে, হারুণ তাহা মনে করে নাই। কাজেই সারাটা রাস্তা জাহাঙ্গীরের সাথে প্রায় দৌড়াইয়া সে যখন তাহার স্বগ্রামের প্রান্তে আসিয়া পঁহুছিল, তখন আর থাকিতে না পারিয়া সে বলিল, ‘দোহাই ভাই, এই গাছতলায় একটু জিরিয়ে নিতে দাও! আর পারছিনে! বাপ! তুমি এতদিন ডাকহরকরা হওনি কেন? হাঁটা তো নয়, এ যেন হন্টন-প্রতিযোগিতার দৌড়!’ হারুণ বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর একেবারে শুইয়া পড়িয়া ঊর্ধ্বনেত্রে গাছের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কী সুন্দর ভাই তোমাদের এই দেশ! পূর্ববঙ্গের মতো একেবারে নিরবকাশ। গাছপালার ভিড় নেই। খানিকটা মাঠ, খানিকটা তেপান্তরের মতো শূন্য ডাঙা, খানিকটা বন জঙ্গল, দূরে দূরে গ্রাম, ক্ষীণাঙ্গী নদী – আমার কী ভালোই লাগছে, তা বলতে পারছিনে। কলকাতার ইটের পাঁজা থেকে বেরিয়ে গায়ে যেন একটু সুন্দর পবিত্র বাতাস লাগল। এমনই একটি ছোটো গাঁয়ে তোমার ওই বক্কেশ্বর নদীর ধারে যদি আমার একটি কুটির থাকত, তাহলে সারাদিন ওই ছেলেগুলোর সাথে গোরু চরিয়েই কাটিয়ে দিতে পারতাম।’
তাহার জন্মভূমির এই প্রশংসায় হারুণের বুক গর্বে খুশিতে ভরিয়া উঠিল। তাহার চক্ষু অকারণে জলে পুরিয়া উঠিল। সেই অশ্রু-পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা-আর্দ্র দৃষ্টি লইয়া হারুণ তাহার পল্লিজননীর পানে চাহিয়া রহিল। গণ্ড বাহিয়া দুই বিন্দু অশ্রুজলও বুঝিবা গড়াইয়া পড়িল। তাহার মনে হইতে লাগিল, তাহার এই গাঁয়ের পথের মাটি দুই হাতের অঞ্জলি পুরিয়া মাথায় মুখে মাখিয়া পবিত্র হইয়া লয়! লজ্জায় তাহা পারিল না, পার্শ্বেই জাহাঙ্গীর শুইয়া। সে অপ্রতিভ হইয়া বলিল, ‘জাহাঙ্গীর! সামনের পুকুরটাতে পা হাত ধুয়ে নাওনা ভাই! তোমার যে বুক পর্যন্ত ধুলো উঠেছে দেখছি! সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু তোমায় এই ধুলোর গেরুয়া রঙে রাঙা হয়ে। তুমি যেন ঘরছাড়া বাউল!’ মুগ্ধদৃষ্টি দিয়া সে জাহাঙ্গীরের উচ্ছৃঙ্খল কেশ-বেশ দেখিতে লাগিল!