হারুণ প্রায় লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘উহ্ঃ! এ কী! তুমি এলে কখন?’ – বলিয়া বাহুতে হাত বুলাতেই লাগিল।
জাহাঙ্গীর উদাস স্বরে বলিল, ‘জগতে শুধু কবির স্বপ্নই নাই কবি, অ-কবির রাম চিমটিও আছে!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘এর পরেও যদি তাতে সন্দেহ প্রকাশ করি, তা হলে হয়তো তুমি ট্যাক্সি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বলবে, যে, কবির স্বপ্নলোকের চেয়েও সত্যি এই মাটির পৃথিবীটা এবং ওই মাড়োয়ারি-কণ্টকিত ফুটপাথটা!’
হঠাৎ হারুণ দেখিতে পাইল ট্যাক্সি হাওড়া স্টেশনের দিকে না যাইয়া বাগবাজারের দিকে ছুটিতেছে। সে একটু চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওহে জাহাঙ্গীর, এ যে, বাগবাজার এসে পৌঁছলুম আমরা। এখানে হাওড়া স্টেশন পাওয়া যায় নাকি?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘না, এখানে পাওয়া যায় চণ্ডু আর রসগোল্লা।’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘ বুঝেছি! তুমি আজকাল ওই প্রথম চিজটা একটু বেশি করেই টানছ মনে হচ্ছে।’
ট্যাক্সি এক সন্দেশের দোকানের সামনে আসিয়া থামিতেই জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দেখলে! ট্যাক্সিরও রসবোধ আছে!’ বলিয়াই সে নামিয়া পড়িল।
হারুণ হতাশ হইয়া বলিল, ‘আজ স্টেশনে বসে বসে ওই মিষ্টিই খেতে হবে। ট্রেন আর পাওয়া যাচ্ছে না।…
গ্রীষ্মের রৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্ন।….
উল্কাবেগে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর বাহিয়া চলিয়াছে ট্রেন। সুখে আলস্যে হারুণ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। শুধু জাহাঙ্গীর জানালার বাহিরে মুখ রাখিয়া রৌদ্র-প্রতপ্ত আকাশের চোখে চোখ রাখিয়া চাহিয়া আছে। ট্রেনের প্রচণ্ড গতিবেগকে ছাড়াইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে তাহার মন ওই তাপদগ্ধ আকাশের পানে। সে যেন আকাশের ওই তপ্ত ললাটে ললাট রাখিয়া তাহার ললাটের জ্বালা অনুভব করিবে। মধ্যাহ্নের দীপ্ত সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করিতেছে। তপ্ত চুল্লির সম্মুখে বালিকাবধূর মতো ধরণি এলাইয়া পড়িয়াছে।
জাহাঙ্গীর দুই হাত তুলিয়া ললাট স্পর্শ করিয়া মধ্যাহ্ন-দিনের সূর্যকে নমস্কার করিল। তাহার চক্ষু জলে টইটুম্বুর হইয়া উঠিল। সেই অশ্রুসিক্ত চক্ষু সূর্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া সে আপন মনে বলিতে লাগিল, জানি না বন্ধু, তোমার বুকে কীসের এ জ্বালা! কোন অভিমানে তুমি পুড়াইয়া মারিতেছ এই শান্ত ধরণিকে! আমার এ-বুকে তোমারই মতো জ্বালা বন্ধু! কিন্তু সে জ্বালায় জ্বলিয়া আমিও কেন তোমার মতো মধ্যাহ্ন-দিনের সূর্য হইয়া উঠি না? কেন আমার জ্বালা তাহার জ্বালার সাথে আলোও দান করিতে পারে না?
ছোট! ছোট! ওরে যন্ত্ররাজের দুরন্ত শিশু! ছোট তুই আরও – আরও – আরও বেগে! নিয়ে চল একেবারে ওই সূর্যের বহ্নিপিণ্ডের বুকে। চল–চল ওরে ধরার ধূমকেতু। চল ওই জ্বালা-কুণ্ডের হামাম-সিনানে! ঝাঁপাইয়া পড়, যেমন করিয়া কোটি কোটি উল্কাপিণ্ড ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে ওই জ্বালা-কুণ্ডে!
কুহেলিকা – ০৬
শিউড়ি যখন তাহারা পঁহুছিল, তখন রাত্রি বেশ ঘনাইয়া আসিয়াছে।
হারুণ বলিল, ‘এখন, কী করা যায় বলো তো? এখানেই রাত্রিটা কাটিয়ে দেবে না শহরে যাবে! শহরে আমার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আছেন, যদি তোমার মত হয় সেখানেও যেতে পারি।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়বাড়ির চেয়ে স্টেশনের প্লাটফর্ম ঢের বেশি সোয়াস্তিকর হারুণ। ব্যাস! খোলো গাঁঠরি! এমন চাঁদনি রাত, প্লাটফর্মে শুয়ে দিব্যি রাত্তির কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আর, যদি বল রাত্তিরেই তোমার বক্কেশ্বর পাড়ি দিতে হবে, তাতেও রাজি।’
হারুণও হাসিয়া বলিল, ‘বেশ, সেই ভালো। কিন্তু প্লাটফর্মের কাঁকরগুলো সারা রাত্তির হয়তো পিঠের সঙ্গে রসিকতা করবে।’
জাহাঙ্গীর তোরঙ্গটার উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘কাঁচকলার কবি তুমি। এমন চাঁদনি রাতের চাঁদোয়ার তলে শুয়েও যে পিঠের তলায় কাঁকরগুলোকে তুলতে পারে না, সে হচ্ছে – কী বলে ইয়ে এই – পাটের দালাল!’
হারুণ হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘এ কীরকম উপমাটা হল?’
জাহাঙ্গীর কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিল, ‘ড্যাম ইয়োর উপমা! তোমার ওই উপমার লেসবুনুনি দিয়ে মানুষের মোক্ষলাভ হবে না! যত সব কুঁড়ে আঁস্তাকুঁড়।’
হারুণ বলিল, ‘কিন্তু এই কুঁড়ের আস্তাকুঁড়েই পদ্মফুল ফোটে জাহাঙ্গীর!’
জাহাঙ্গীর সিগারেটের মুখাগ্নি করিতে করিতে বলিল, ‘সে আস্তাকুঁড়ে নয় কবি, সে ফোটে তোমাদের ওই মাথার গোবরে! কিন্তু ও কাব্যালোচনা এখন চুলোয় যাক, এ সিগারেটের ধোঁয়ায় তো আর পেট ভরবে না। পেটের ভিতর যে এদিকে বেড়াল আঁচড়াচ্ছে। তুমি এই সব পাহারা দাও, আমি চললাম খাদ্যান্বেষণে।’
হারুণ কী বলিতে যাইতেছিল, তাহাকে এক দাবড়ানিতে থামাইয়া দিয়া জাহাঙ্গীর চলিয়া গেল। হারুণ নিরুপায় হইয়া প্লাটফর্মে পরিপাটি করিয়া বিছানা পাতিয়া গা এলাইয়া শুইয়া পড়িল।
গ্রীষ্মের সচন্দ্রা যামিনী। তাপদগ্ধ আকাশের নীল দেহে কে যেন গোপী-চন্দন অনুলিপ্ত করিয়া দিয়াছে। রৌদ্রদগ্ধ দিবস, রাত্রির শীতলকোলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বাঁদির মতো তরুর সারি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কেবল বীজন করিতেছে।
আবেশে তন্দ্রায় হারুণের চক্ষু জড়াইয়া আসিল। এই দুঃখের অভাবের ধুলার পৃথিবী তাহার স্বপ্নে অপরূপ হইয়া ফুটিয়া উঠিল। ইহার হাসি যেমন মায়াবী, ইহার অশ্রুও তেমনই জাদু জানে। এই মায়াবিনীকে তাহার একটি ক্ষীণাঙ্গী বালিকার মতো করিয়া বুকে চাপিয়া ধরিতে ইচ্ছা করিল!
হঠাৎ জাহাঙ্গীরের রাম-ঠেলায় সচকিত হইয়া হারুণ উঠিয়া বসিয়া দেখিল, ‘জাহাঙ্গীরের খাদ্যান্বেষণ’ ব্যর্থ হয় নাই। শিউড়ির যাহা কিছু ভালো বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে, সে তাহার সব কিছুই চ্যাঙারি বোঝাই করিয়া আনিয়াছে।