আরাধ্যা গঙ্গা মর্ত্যে স্বয়মাগতা নন। মহাকাব্য মহাভারতের বনপর্বে গঙ্গার আখ্যান আছে।
ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সগর পুত্রকামনায় সুমতি ও কেশিনী নাম্নী পত্নীদ্বয় সমভিব্যাহারে কৈলাস পর্বতে উপস্থিত হলেন। অযুত সৈন্যের অধিপতি শক্তিমান সগর স্বয়ং এরূপ কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলেন যে, কৈলাসপতি মহাদেব সগররাজাকে এক মহাবর দিলেন। সেই বরে সগরের এক পত্নীর গর্ভে জন্মাল ষষ্টি সহস্র পুত্র। অপর পত্নীর গর্ভে মাত্র একজন। সুমতি হলেন ষাটহাজার পুত্রের মাতা। কেশিনীর সন্তান একটি। এই একজনের নাম অসমঞ্জ। অসমঞ্জার প্রকৃতি ভয়ানক এবং চরিত্র খল। রাজা সগর অসমঞ্জার কুকীর্তিগুলি অবগত হয়ে তাকে নির্বাসন দিলেন।
সগরের অবশিষ্ট ষষ্টি সহস্র পুত্র ছিলেন বীর এবং গুণবান। পুত্রধনে গর্বিত রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞের অশ্ব সগরের পুত্রগণের দ্বারা রক্ষিত হচ্ছিল। সুরক্ষিত বিচরণকালে সে এক জলশূন্য সমুদ্রের তীরে এসে উপস্থিত হল এবং সহসা অন্তর্হিত হল। এই অন্তর্ধানের সংবাদ শোনামাত্র রাজা সগর পুত্রগণকে আদেশ করলেন–তোমরা সকল স্থানে, সকল দিকে অশ্বের অন্বেষণ করো।
সুপুত্রগণ সকল সম্ভাব্য স্থানে অন্বেষণ করে অশ্ব না পেয়ে সমুদ্র খনন করতে লাগলেন। তাঁদের প্রকোপে অসুর, নাগ, রাক্ষস ও বহুবিধ সামুদ্রিক প্রাণী নিহত হল। অবশেষে সমুদ্রের উত্তর-পূর্ব দেশ খনন করে পালে পৌঁছে তারা দেখলেন, অশ্ব পাতালে বিচরণ করছে। অদরে মহাত্মা কপিলের আশ্রম। সগরপুত্রগণ জ্যোতিঃপূর্ণ মুনিকেই তস্কর জ্ঞান করে ক্রোধে আস্ফালন করতে লাগলেন এবং তৎক্ষণাৎ মুনির তেজদীপ্ত দৃষ্টির দ্বারা ভস্মীভূত হলেন।
সুপুত্রগণের ভস্মীভবনের সংবাদ রাজা সগরের নিকট পৌঁছে দিলেন মহর্ষি নারদ। শোকাভিভূত সগর অসমঞ্জপুত্র অংশুমানকে বললেন–পৌত্র! তুমি গমন করো। যজ্ঞা অন্বেষণ করিয়া আমাদিগকে নরক হইতে উদ্ধার করো।
অংশুমান পাতালে গমন করলেন। প্রশান্ত ও ভক্তিবিনম্র চিত্তে কপিলমুনিকে প্রণাম করে বললেন—মুনিবর, আপনি প্রসন্ন হউন। আমাকে দয়া করুন। আমি পিতামহের মুক্তির নিমিত্ত আপনার নিকট যজ্ঞা প্রার্থনা করিতেছি। পিতৃব্যগণের মুক্তির নিমিত্ত আপনার নিকট পবিত্র বারি প্রার্থনা করিতেছি। আপনি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করুন।
কপিল প্রসন্ন হয়ে বললেন, বৎস, আমি আশীর্বাদ করিতেছি। তুমি যজ্ঞাশ্ব লইয়া গৃহাভিমুখে প্রত্যাগমন করো। মহারাজা সগরের যজ্ঞ সমাপ্ত করো। কিন্তু তোমার পিতৃব্যগণ সহজে উদ্ধার পাইবেন না। তোমার এক মহাতেজা পৌত্র জন্মিবেন। তাহার নাম ভগীরথ। তিনি তপস্যা দ্বারা দেবাদিদেবকে তুষ্ট করিয়া স্বর্গ হইতে গঙ্গা আনয়ন করিবেন। গঙ্গাবারি স্পর্শে তোমার পিতৃব্যগণ উদ্ধার পাইবেন।
অংশুমান সগরের নিকট সকলই ব্যক্ত করলে সগর পুনরায় শোকাভিভূত হলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপন করে তিনি সমুদ্রকে উদ্দেশ করে বললেন, হে সমুদ্র! তুমি আমার যষ্টি সহস্র পুত্রের ভস্ম ধারণ করিয়াছ। তোমাকে আমি আমার পুত্রগণ হইত আর পৃথক দেখি না। আজি হইতে তোমাকে আমার পুত্র জ্ঞান করিলাম। আজি হইতে তুমি সাগর হইলে।
যথাকালে সগর স্বর্গলাভ করলে অংশুমান রাজা হলেন। অংশুমানের পুত্র দিলীপ, দিলীপের পুত্র ভগীরথ। রাজ্যলাভ করে, অমাত্যবর্গের নিকট শাসনভার অর্পণ করে ভগীরথ তপস্যার উদ্দেশ্যে হিমালয় গেলেন।
দিন গেল, মাস গেল, বৎসর গোল। এবং এক এক বৎসর করে সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হল। অবশেষে গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে দর্শন দিলেন। ভগীরথ গঙ্গাপদে প্রণত হয়ে বললেন-দেবি। আমার পূর্বপুরুষ সগরপুত্রগণ কপিলমুনির শাপে ভস্মীভূত আছেন। আপনি মর্ত্যে অবতীর্ণা হউন। আপনার স্পর্শে পবিত্র হইয়া তাহারা স্বর্গলাভ করুন।
গঙ্গা বললেন, বৎস, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিব। তৎপূর্বে তুমি তপস্যাবলে মহাদেবকে তুষ্ট করিয়া বর প্রার্থনা করো। তিনি যেন মত্যাগমনকালে আমাকে মস্তকে ধারণ করেন।
ভগীরথ কৈলাস পর্বতে গমন করলেন। কঠোর তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করলে মহাদেব ভগীরথের প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। পুণ্যতোয়া দেবী গঙ্গা শিবের জটাজুটে আধারিতা হলেন। বিষ্ণুপদ হতে নিঃসৃত গঙ্গা মর্তে আপতনকালে সকলই বিস্মৃত ছিলেন। শিবের আশিসে সকলই স্মরণ হল। মহাদেবের জটা হতে ত্রিধাবিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হলেন তিনি। ভগীরথ বিনম্র ভক্তিপূর্ণ চিত্তে গঙ্গাকে স্মরণ করলে প্রণত ভগীরথকে গঙ্গা বললেন, পিতঃ, আমি তোমার দুহিতা হইলাম। কারণ তুমি আমাকে মর্তে আনয়ন করিয়াছ। আমাকে তুমি ভাগীরথী সম্বোধন করিয়ে। তোমার পূর্বপুরুষগণকে আমি অবশ্য উদ্ধার করিব। তুমি আমাকে পথ প্রদর্শন করো।
ভগীরথ বললেন, অয়ি ভাগীরথি! তুমি সত্যই আমার দুহিতা হইলে। আমি শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছি। তুমি আমার অনুসরণ করো।
গঙ্গা ভগীরথের শঙ্খধ্বনি অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। পথিমধ্যে এক স্থানে ভগীরথ অশ্বের পিপাসা নিবৃত্তির হেতু বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালেন। সেই স্থানে পদ্মাবতী নাম্নী এক কন্যা তার সহোদরা গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আগমন করছিলেন। স্বভাবে তিনি ছিলেন কিছু চটুল এবং ভাঙনপ্রিয়। কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে গঙ্গা বিপথগামিনী হবেন না এই উপলব্ধি আঁর ছিল। তাই গঙ্গাকে আহ্বান করার জন্য তিনি ভগীরথের অনুরূপ শঙ্খধ্বনি করলেন। গঙ্গা ভ্রমবশত পদ্মার শঙ্খধ্বনিকে ভগীরথের শঙ্খধ্বনি জ্ঞান করে ভিন্নমুখে চললেন। ভগীরথ এতদ্বিষয় অজ্ঞাত থেকে যথাসময়ে শঙ্খধ্বনি করলে গঙ্গার ভ্রম ভঙ্গ হল। তিনি পদ্মার খাত পরিত্যাগ করে স্বখাতে প্রত্যাগমন করলেন। গঙ্গা পদ্মকে পরিত্যাগ করায় পদ্মার পবিত্রতা বিনষ্ট হল।