- বইয়ের নামঃ রাজপাট
- লেখকের নামঃ তিলোত্তমা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. অতঃপর তিনি বিষ্ণুর পদপ্রান্ত হতে উৎসৃতা হলেন
এ উপন্যাসে ময়না বৈষ্ণবী স্বয়ং গঙ্গার মতো পাপপ্রক্ষালনকারিণী। মহাপ্রাণ বৈষ্ণবীকে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। কিন্তু তার অস্তিত্ব অনির্বাণ চিরদীপ হয়ে রইল মুর্শিদাবাদের প্রাণবায়ুর ভিতর। এই প্রজ্জ্বলন সঙ্গে করে পথ চলেছে সিদ্ধার্থ। তৌফিক তার সঙ্গী। দুলুক্ষ্যাপা তার সহায়। মুর্শিদাবাদের অগণিত মানুষ তার নির্ভরতা। ময়না বৈষ্ণবী ও সিদ্ধার্থকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস মুর্শিদাবাদের মাটি ও মানুষের গভীর উপাখ্যান।
———-
০০১.
অতঃপর তিনি বিষ্ণুর পদপ্রান্ত হতে উৎসৃতা হলেন। আকাশগঙ্গা রূপে প্রবাহিতা মন্দাকিনী নাম্নী অই তরঙ্গিণী মতাভিমুখে প্রবল শক্তিতে ধাবিতা হলে তার রূপালোকে দশদিশি ভরা অন্ধকার বিদূরিত হল। তাঁর উল্লোল বিভঙ্গে দেবগণ বিমোহিত হলেন। তাঁর উম্মত্ত বেগ এবং অমেয় শক্তি স্বর্গের অক্ষয়ভূমির ক্ষয় ঘটাতে পারল না সত্য, কিন্তু রূপাবিষ্ট দেবগণ শঙ্কিত হলেন। সকল সৌন্দর্য ও শক্তি সংবলিত অই তটিনী মর্ত্যে আছড়িয়ে পড়বেন আর তৎক্ষণাৎ মর্ত্যভূমি শতধাবিদীর্ণ হবে। প্লাবিত হবে। পৃথিবীতে ঘটে যাবে এক মহাপ্রলয়।
তখন দেবগণ দেবাদিদেবকে স্মরণ করলেন। মহাদেব ত্রিকালজ্ঞ। অতএব সমূহ উন্মত্ত মহাপ্রলয় হতে, দেবগণের অপরূপ কীর্তি মর্ত্যভুবনকে রক্ষা করার নিমিত্ত, দুই হস্ত প্রসারিত করে মহাদেব বললেন, অয়ি গঙ্গে! আমি তোমাকে গ্রহণ করিলাম। আইস। আমাতে আশ্রয় লও।
গঙ্গা! ইনি গঙ্গা! ইনি মর্তের পুণ্যবান রাজা ভগীরথের তপস্যায় উৎসৃষ্ট এবং দেবাদিদেবের আহ্বানে উৎফুল্ল উচ্ছলতায় স্বর্গদ্বার অতিক্রম করে প্রপাত হলে শিব আপন জটাজুটে দেবীকে ধারণ করলে গঙ্গা মহাদেব দ্বারা বিবাহিতা হলেন। জটায় আবদ্ধ গম্বার প্রবাহ নিবৃত্ত হল। সহসা তিনি সকলই বিস্মৃত হলেন। আপন মনে ভাবতে লাগলেন-আমি কোথা হইতে আসিতেছি! কোথায় যাইব! এই জটাজুটে বন্ধন পড়িলাম কীরূপে! আমি যেন কার আবাহন শুনিয়াছিলাম। কে আমাকে স্মরণ করিল! এক্ষণে আমি শিবের দ্বারা বিবাহিতা হইয়াছি। তাহাকেই জিজ্ঞাসা করি।
অতএব গঙ্গা জটায় জলদেহভার রেখে সুরূপে শিবের মুখোমুখি হয়ে বললেন— স্বামি! আমাকে বন্দি করিলে কেন? প্রবাহই আমার ধর্ম। গতিই আমার প্রবৃত্তি। আমাকে মুক্ত করো।
শিব তাঁর পরমসুন্দর মনোহর মুখে হাস্য আনয়ন করলে সেই হাস্য গঙ্গাতে দিল সৃষ্টির পারঙ্গমতা। ধ্বংসের শক্তি তিনি উৎসারকালেই পেয়েছিলেন। এবার সৃষ্টি সংযুক্ত হলে শিব মন্দ্রকণ্ঠে বললেন–কল্যাণি! তোমাকে বন্দি করি নাই। সাময়িক তোমাকে ধারণ করিয়া তোমার গতিপ্রাবল্য রোধ করিলাম। তুমি চিরমুক্তা। তুমি সচ্ছন্দা। স্বাধীনা। তুমি যুগে-যুগান্তরে প্রবাহিতা হইবে। তুমি ইতিহাস সৃষ্টি করিবে এবং তাহা ধারণ করিবে। অই গঙ্গে! শুধুই বহমানতার সার্থকতা কী! সৃষ্টি না করিলে সকল ধর্মেই আসে ক্লান্তি। পবিত্রে গঙ্গে! তুমি কলুষনাশিনী। সকল পাপ তুমি শোধন করিবে। তোমার বল অমিত। শক্তি অপরিমিত। পৃথিবী বড় অশক্ত। বড় দুর্বল। তোমার পূর্ণ শক্তি উহাতে প্রয়োগ করিয়ো না। সংযতা-প্ৰবাহিণী হও। রাজা ভগীরথের গভীর তপস্যাবলে তুমি আনীতা। অতএব, অয়ি গঙ্গে, তুমি, আজি হইতে ভাগীরথী হইলে।
বিনতা গঙ্গা দেবাদিদেবের সকল বাক্য কায়মনে শ্রবণ করলেন। সকলই তার হৃদয়ে উপলব্ধ হল। তিনি সংযতাপ্ৰবাহিণী হলেন। তাঁর দুই তীরে জন্মাল কত নগর, জনপদ, কত গ্রাম। কত ফসলের ক্ষেত। কল-কারখানা কত। যে-দেশে গঙ্গা বয় সে-দেশই হয় সুজলা সুফলা। ইতোমধ্যে গঙ্গাবারি স্পর্শে পাপীগণ পুণ্যবান হলে মর্তবাসী গঙ্গার মহিমা অবগত হল। গঙ্গা পূজিতা হলেন।
দেবি সুরেশ্বরী ভগবতি গঙ্গে,
এ ত্রিভুবনতারিণী তরলতরঙ্গে।
শঙ্করমৌলিবিহারিণি বিমলে,
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।
ভাগীরথী সুখদায়িনি মাতস্তব,
জলমহিমা নিগমে খ্যাতঃ।
নাহং জানে তব মহিমানং
ত্রাহি কৃপাময়ী মামজ্ঞানং॥
হরিপদপদ্মে তরঙ্গিণি গঙ্গা,
হিমবিধুমুক্তাধবলতরঙ্গে।
দূরীকুরু মম দুষ্কৃতিভারং,
কুরু কৃপাময়ী ভবসাগরপারং॥
ত্রিভুবনতারিণী গঙ্গে। পাপী তাঁর পূতস্পর্শে পাপমুক্ত হয়ে চলেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী শয্যা পেতেছেন তাঁরই সংলগ্ন। গঙ্গাযাত্রা। জীবিতের প্রিয়তম কামনা অক্ষয় স্বর্গবাস। গঙ্গাপ্রান্তে দেহরক্ষা করলে অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়। কত জীবিতের কত কত প্রিয়জন এই তীরে গত হলেন। দেহরক্ষা করে চিতার অগ্নিধূম সম্বলে স্বর্গারোহণ করলেন। গত ব্যক্তি মায়ামুক্ত হলেন। কিন্তু জীবিত ব্যক্তি মায়ার বন্ধনে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। তার অশ্রু গঙ্গায় আশ্রয় পেল। গঙ্গা নির্বিকারে এই শোকাশ্রু গ্রহণ করলেন। তাঁর আশিস শোকসন্তপ্তকে বিধৌত করল। তাকে এই শক্তি দিল যে, দু-চারিদিন পরেই প্রিয়জনের শোকস্মৃতি তাঁর চিত্তে আবছায়া হল। শোক বিস্মৃত হতে না পারলে মানুষের চলে না। এমনকী মন যদি না ভোলে, দেহ মনকে পাগল করে শোকের উর্ধ্বে তুলে দেয়।
শরীরে জর্জরিভৃতে ব্যাধিগ্রস্তে কলেবরে।
ঔষধম জাহ্নবী তোয়ম বৈদ্য নারায়ণো হরি॥
ব্যাধিগ্রস্ত শরীরে গঙ্গা তুমিই ঔষধ। আর শ্রীহরি স্বয়ং বৈদ্য।