—ফেলে দিলে?
–হ্যাঁ। গাছ কাটছিল, সেই কাটা শেকড়ে লেগে দুজনকারই মাথা ফেটে গেল।
–তারপর?
–খুব রক্ত পড়ছে। ধরাধরি করে ধরে নিয়ে আসছে।
–অন্য লোকেরা কি করছিল?
—সব দাঁড়িয়েছিল, কেউ এগোয় নাই। কর্মকার কেবল একজন লেঠেলকে এক লাঠি মেরে পালিয়েছে।
–জগন ডাক্তার কোথায়?
–সে জংশনে গিয়েছে—পুলিশের কাছে।
যতীন ঘরে ঢুকিয়া লিখিতে বসিল; টেলিগ্রাম। একখানা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একখানা এসডিওর কাছে। আর একখানা চিঠি—এ জেলার জেলা-কংগ্রেস কমিটির কাছে। চিঠিখানা গোপনে পাঠাইতে হইবে।
টেলিগ্রাম করিতে ডাক্তারকে পাঠাইতে হইবে। কিন্তু এ পত্ৰখানা জগনের হাতে দেওয়া। হইবে না। দেবু ভাল থাকিলেই তাহাকে সদরে পাঠানো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হইত। সে একটু ভাবিয়া নেলোকে ডাকিয়া বলিল—একটা কাজ করতে পারবে?
নলিন ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল–হ্যাঁ।
–একখানা চিঠি জংশনের ডাকঘরে ফেলতে হবে। একটা চার পয়সার টিকিট কিনে বসিয়ে দেবে। কেমন?
নলিন আবার সেই ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল।
—কাউকে দেখিয়ো না যেন।
নলিনের আবার সেই নীরব স্বীকৃতি।
—এই চার পয়সার টিকিট কিনবে। আর এই চার পয়সার তুমি জল খাবে।
নলিন চিঠিখানি কোমরে রাখিয়া তাহার উপর সযত্নে ভঁজ করিয়া কাপড় বাঁধিয়া ফেলিল। আনি দুইটি বাঁধিল খুঁটে। তারপর ঘাড় হেঁট করিয়া যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে চলিয়া গেল।
সমস্ত গ্রামখানা চঞ্চল হইয়া উঠিল।
জগন ডাক্তারের ডাক্তারখানায় দেবু ও চৌধুরীকে আনা হইয়াছিল। দেবু নিজে হটিয়াই আসিয়াছে। তাহার আঘাত তেমন বেশি নহে, তা ছাড়া তাহার জোয়ান বয়স-উত্তেজনাও যথেষ্ট হইয়াছিল; রক্তপাত বেশ খানিকটা হইলেও সে ভীত বা অবসন্ন হয় নাই। কিন্তু বৃদ্ধ চৌধুরী কাতর হইয়া পড়িয়াছে, আঘাতও তাহারই বেশি। প্রথমে চৌধুরী সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িয়াছিল; চেতনা হইলেও ধরাধরি করিয়া বহিয়া আনিতে হইয়াছে। চৌধুরী চোখ বুজিয়া শুইয়াই আছে। দেবু নীরবে বসিয়া আছে দেওয়ালে ঠেস দিয়া। ধুইয়া দেওয়ার পর রক্তাভ জলের ধারা কপাল বাহিয়া এখনও ঝরিতেছে। প্রায় সমস্ত গ্রামের লোকই জগনের ডাক্তারখানার সম্মুখে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে।
টিঞ্চার আয়োডিন, তুলা, গরম জল, ব্যান্ডেজ লইয়া জগন ব্যস্ত। হরেন তাহাকে সাহায্য করিতেছে। মাঝে মাঝে হাঁকিতেছে—হট যাও। ভিড় ছাড়। রাঙাদিদি একটা গাছতলায় বসিয়া কাঁদিতেছে। দুর্গা পাঁতে দাঁত টিপিয়া নিম্পলক নেত্রে দাঁড়াইয়া আছে। এমন সময় ডাক্তারখানায় যতীন আসিয়া উঠিল।
জগন বলিল গাছ সব আটকে দিয়েছি—পুলিশ এসে নোটিশ জারি করে গিয়েছে। কোনো পক্ষই গাছের কাছে যেতে পারবে না। আমি বারণ করে গেলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু কোরো না। কাটুক গাছ। ফিরে এসে দেখিদেবু এই কাণ্ড করে বসে আছে। অনিরুদ্ধ একজনের পিঠে এক লাঠি কষে পালিয়েছে।
ভিড়ের ভিতর হইতে অনিরুদ্ধ আগাইয়া আসিয়া বলিল—অনিরুদ্ধ ঠিক আছে। সে মেয়ে নয়—মরদ। অনিরুদ্ধের হাতে তাহার টাঙ্গি। সে বলিলটাঙ্গিটা তখন যে হাতের কাছে। পেলাম না! নইলে হয়েই যেত এক কাণ্ড!
যতীন বলিল—সেসব পরে যা হয় করবেন—এখন এঁদের তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করে। ফেলুন।
বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী এতক্ষণে চোখ মেলিয়া মৃদু হাস্যের সহিত হাত জোড় করিয়া বলিল–প্ৰণাম।
যতীন প্রতি-নমস্কার করিল—নমস্কার। কেমন বোধ করছেন?
–ভাল। মৃদু হাসিয়া বৃদ্ধ আবার বলিল—মনে করলাম মাঝে পড়ে মিটিয়ে দোব। দেবু গিয়ে কুড়ুলের সামনে দাঁড়াল। থাকতে পারলাম না চুপ করে।
সকলে চুপ করিয়া রহিল। এ কথার কোনো উত্তর দিবার ছিল না।
বৃদ্ধ বলিল পণ্ডিত নমস্য ব্যক্তি। শুধু পণ্ডিতই নয়, বীরপুরুষ। বয়স হলেও চশমা আমার এখনও লাগে না, দেবতা। কুড়ুলের সামনে পণ্ডিত যখন গিয়ে দাঁড়াল—তখনকার সে মূর্তি পণ্ডিত নিজেও বোধহয় কখনও আয়নায় দেখে নাই। বীরপুরুষ!
জগন বলিল—এগুলো হল গোঁয়ার্তুমি কি ফল হল? রাগ কোরো না, ভাই দেবু।
হাসিয়া বৃদ্ধ বলিল—সবার গাছই কেটেছে। গাছ এখনও দেবুরই দাঁড়িয়ে আছে, ডাক্তার।
জগন হরেন ঘোষালকে একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়া উঠিল—কোন্ দিকে চেয়ে কাজ করছ ঘোষাল?
হরেন চমকিয়া উঠিল।
দেবু হাসিল। ডাক্তার বৃদ্ধের উপর চটিয়াছে। ঝালটা পড়িল হরেনের উপর।
***
পুলিশের একটা তদন্ত হইল।
শ্ৰীহরি কোনো কথাই অস্বীকার করিল না। শ্রীহরির পক্ষে কথাবার্তা যাহা বলিবার বলিল–দাশজী। দাশজী এখন জমিদারের সদর-কর্মচারী, এখানকার ভূতপূর্ব গোমস্তা। অভিজ্ঞ, সুচতুর, বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। প্রজাস্বত্ব আইনে, ফৌজদারি আইনে সে সাধারণ উকিল-মোক্তার অপেক্ষাও বিজ্ঞ। শ্ৰীহরি সংবাদ পাইয়া তাহাকে আনিয়াছে। ব্যাপারটা এখন আর গ্রামের লোক এবং ব্যক্তিগতভাবে শ্রীহরির মধ্যে আবদ্ধ নয়। জমিদারের গোমস্তা হিসাবে সে ব্যাপারটা। করিয়াছে, সুতরাং দায়িত্ব জমিদারের উপরও পড়িয়াছে।
জমিদার বয়সে নবীন। এ-কালের বাংলাদেশের জমিদারের ছেলে। ইংরাজি লেখাপড়া জানে, জমিদারি খুব পছন্দ করে না। বারকয়েক ব্যবসা করিবার চেষ্টা করিয়া লোকসান দিয়া অগত্যা জমিদারিকেই অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া আছে। জমিদারির মধ্যে আইন অনুযায়ী চলিবার প্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা তাহার আছে, সেকালের জমিদারের মত জোরজবরদস্তির যারা সে মোটেই পছন্দ করে না। সেকালের জমিদারের মত ব্যক্তিত্বও তাহার নাই। কাজেই তার সাধু চেষ্টা। ফলবতীও হয় নাই। কলিকাতা যাইবার টাকার অভাব ঘটিলেই নায়েব-গোমস্তার মতে মত দিতে বাধ্য হয়। কলিকাতায় সিনেমা দেখে, থিয়েটার দেখে, একটু আধটু মদও খায়, রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে দর্শক হিসাবে যায়। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার; লোকাল-বোর্ডে দাঁড়াইয়া এবার পরাজিত হইয়াছে। আগামী বারে কংগ্রেস-নমিনেশন পাইবার জন্য এখন হইতেই চেষ্টা করিতেছে। এবার অর্থাৎ উনিশ শো আটাশ সালে কলিকাতায় যে কংগ্রেস অধিবেশন হইবে—তাহার ডেলিগেট হইবার চেষ্টাও সে এখন হইতেই করিতেছে।