–দরকার নেই।
–না, দরকার আছে।
যতীন দরজা খুলিয়া দিল। পদ্ম যতীনের শিয়রে পাখা লইয়া বসিল। বলিল একজন বেরিয়েছে দুগ্গাকে সাপে কামড়েছে বলে—এখনও ফিরল না। তুমি–
—অনিরুদ্ধবাবু এখনও ফেরেন নাই!
–না। দাঁড়াও; দুগ্গা মরুক আগে, তারপর ফিরবে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। দুনিয়ায় এত লোকে মরেওই হারামজাদী মরে না।
যতীন শিহরিয়া উঠিল। পদ্মের কণ্ঠস্বরে ভাষায় সে কি কঠিন আক্রোশ! দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে চোখ বন্ধ করিল। কিছুক্ষণ পরই তাহার কানে একটা দূরাগত বিপুল শব্দ যেন জাগিয়া উঠিল। দ্রুততম গতিতে শব্দটা আগাইয়া আসিতেছে। ঘরেদুয়ারে একটা কম্পন জাগিয়া উঠিতেছে। সে উঠিয়া বসিয়া বলিল ভূমিকম্প!
হাসিয়া পদ্ম বলিল—কি ছেলে মা! যেন দেয়ালা করছে! ও ভূমিকম্প নয়, ডাকগাড়ি যাচ্ছে। শোও দেখি এখন।
—ডাকগাড়ি? মেল ট্রেন?
–হ্যাঁ, ঘুমোও।
সেই মুহূর্তেই তীব্র হুইসিলের শব্দ করিয়া ট্রেন উঠিল ময়ূরাক্ষীর পুলে, ঝুমঝম শব্দে চারিদিক পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ঘর-দুয়ার থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। জংশন-স্টেশনে আলো জ্বলিতেছে। সেখানকার কলে রাত্রেও কাজ চলে। ময়ূরাক্ষীর ওপারেই জংশন। যতীন অকস্মাৎ যেন আশার আলোক দেখিতে পাইল। পল্লী কাঁপিতেছে।
কিছুক্ষণ পরে পাখা রাখিয়া পদ্ম সন্তৰ্পণে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
যাক, ঘুমাইয়াছে। উপরে মশারি ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিয়া আসা হয় নাই, উচ্চিংড়েটাকে হয়ত মশায় ছিঁড়িয়া ফেলিল!
যতীনের ঘর হইতে বাহির হইয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল। উপর হইতে কখন নামিয়া আসিয়াছে। উচ্চিংড়ে। আপন মনেই এই তিন প্রহর রাত্রে উঠানে বসিয়া একা-একাই কড়ি খেলিতেছে।
শেষরাত্রে ঘুমাইয়া যতীনের ঘুম ভাঙিতে দেরি হইয়াছিল। তাহাকে তুলিল পদ্ম।-ওঠ ছেলে! ওঠ!
উঠিয়া বসিয়া যতীন বলিল—অনেক বেলা হয়ে গেছে, না?
–ওদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল!
–সর্বনাশ হয়ে গেল?
–ছিরু পাল লেঠেল নিয়ে এসে গাছ কাটছে। সব ছুটে গেল, দাঙ্গা হবে হয়ত।
–কে ছুটে গেল, অনিরুদ্ধবাবু?
–সব–সব। পণ্ডিত, জগন ডাক্তার, ঘোষাল–বিস্তর লোক।
যতীন খুশি হইয়া উঠিল—বলিল—বেশ কড়া করে চা কর দেখি মা-মণি।
–তুমি কিন্তু নাচতে নাচতে যেয়ো না যেন।
–তবে আমায় ডাকলে কেন?
পদ্ম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—জানি না—
সত্যই সে খুঁজিয়া পাইল না কেন সে যতীনকে ডাকিল!
—মুখ-হাত ধোও। আমি চা করছি।
–উচ্চিংড়ে কই?
–সে বানের আগে কুটো—সে ছুটে গিয়েছে দেখতে।
গতকল্যকার অপমানের শোধ লইয়াছে শ্ৰীহরি। বাউরিবায়েনের কাছে মাথা হেঁট হইয়াছে। শুধু অপমান নয়—তাহার মতে, এটা গ্রামের শৃঙ্খলা ভাঙিবার একটা অপচেষ্টা। তাহার উপর দুর্গা তাহাদিগকে যেভাবে ঠকাইল সে সত্যটা ঘণ্টাদুয়েক পরেই মনে মনে বুঝিয়া ও জানিতে পারিয়া সে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এবং যাহারা ইহার সঙ্গে জড়াইয়া আছে তাহাদের শাস্তি দিবার ব্যবস্থা সে কাল সেই গভীর রাত্রেই করিয়া রাখিয়াছে।
কালু শেখ মারফত লাঠিয়ালের ব্যবস্থা করিয়া আজ সকালে সে জমিদারের গোমস্তা হিসাবে দেবু, জগন, হরেন ও অনিরুদ্ধের গাছ কাটিবার ব্যবস্থা করিয়াছে। গাছগুলি জমিদারের পতিত ভূমির উপর আছে। পূর্বকালে চাষী প্রজারা এমনই ভাবে গাছ লাগাইত, ভোগদখল করিত। জমিদার আপত্তি করিত না। প্রয়োজন হইলে, প্রজাকে দুইটা মিষ্ট কথা বলিয়া জমিদার ফলও পাড়িত, ডালও কাটিত। কিন্তু এমনভাবে সমূলে উচ্ছেদ কখনও করিত না। করিলে বহু পূর্বকালে—এক শশো বছর পূর্বে জমিদার-প্রজা দাঙ্গা বাধিত। পঞ্চাশ বৎসর পরে সে যুগ পাল্টাইয়াছিল। তখন প্রজা জমিদারের হাতে-পায়ে ধরিত, ঘরে বসিয়া গাছের মমতায় কাঁদিত। অকস্মাৎ আজ দেখা গেল, আবার তাহারা ছুটিয়া বাহির হইতেছে।
যতীন ব্যস্ত হইয়া উঠিতেছিল—সংবাদের জন্য। শেষ পর্যন্ত খুনখারাবি হইয়া গেলে যে একটা অত্যন্ত শোচনীয় ব্যাপার হইবে। উদ্বিগ্নভাবে সে ভাবিতেছিল—তাহার যাওয়া কি উচিত হইবে? তাহাকে এই ব্যাপারে কোনোমতে জড়াইতে পারিলে—সমগ্ৰ ঘটনারই রঙ পাল্টাইয়া যাইবে।
পদ্ম ইহারই মধ্যে তিনবার উঁকি মারিয়া দেখিয়া গিয়াছে—সে ঘরে আছে কি না।
যতীন শেষবারে বলিল-আমি যাই নি মা-মণি। আছি।
—তোমাকে বিশ্বাস নাই। সাংঘাতিক ছেলে তুমি।
যতীন হাসিল।
—হেসো না তুমি, হ্যাঁ। কথা বলিতে বলিতে পদ্ম পথের দিকে চাহিয়া বলিল–ওই। ওই লাও, নেললা আসছে। দাও পয়সা দাও।
সেই চিত্রকর ছেলেটি বৈরাগীদের নেললা আসিতেছে। পয়সার প্রয়োজন হইলেই নেলো আসে। অন্যথায় সে আসে না। নিঃশব্দে আসে—চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, প্ৰশ্ন না থাকিলে প্রয়োজন ব্যক্ত করিতে পারে না; কিন্তু উঠিয়া যায় না, বসিয়াই থাকে। প্রশ্ন করিলে সংক্ষেপে বলে-পয়সা। দাবিও বেশি নয়, চার পয়সা হইতে চার আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ কিন্তু নেলো একটু উত্তেজিত, মুখের গৌরবর্ণ রং রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছে, চোখের তারা দুটি অস্থির; সে আসিয়া আজ বসিল না, দাঁড়াইয়া রহিল।
—কি নলিন? পয়সা চাই?
–পণ্ডিতের মাথা ফেটে গিয়েছে।
–কার? দেবুবাবুর?
–হ্যাঁ। আর কালীপুরের চৌধুরীমশায়ের।
–দ্বারকা চৌধুরীমশায়ের?
–হ্যাঁ। পণ্ডিতের আমগাছ কাটছিল, পণ্ডিত একেবারে কুড়ুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
–তারপর?
—লেঠেলদের সঙ্গে পণ্ডিতের ঠেলাঠেলি লেগে গেল। চৌধুরীমশায় গেল ছাড়াতে। তা লেঠেলরা দুজনকেই ঠেলে ফেলে দিল।