শিবপুর গ্রামখানি বহু পূর্বে ছিল—ছোট একটি পাড়াবিশেষ; তখন অর্থাৎ বর্তমান কাল হইতে প্রায় আশি-নব্বই বৎসর পূর্বে সেখানে একশ্রেণীর বিচিত্র সম্প্রদায় বাস করিত; তাহারা নিজেদের বলিত দেবল চাষী। তাহারা নিজ হাতে চাষ করিত না, শিবপুরের বুড়া শিবের সেবাপূজার ভার লইয়া তাহারা মাতিয়া থাকিত। এখন এই দেবল সম্প্রদায়ের আর কেহই নাই। অধিকাংশই মরিয়া-হাজিয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট কয়েক ঘর এখান হইতে অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে। ক্ৰোশ পাঁচেক দূরবর্তী রক্ষেশ্বর গ্রাম এবং ক্রোশ আষ্টেক দূরবর্তী জলেশ্বর গ্রাম-বাবা রক্ষেশ্বর। ও বাবা জলেশ্বর এই নামীয় দুই শিবের আশ্রয় লইয়া পাণ্ডা হিসেবে তাহাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাস করিতেছে। শিবভক্ত দেবলদের বাস ছিল বলিয়াই পল্লীটার নাম ছিল শিবপুর। দেবলেরা চলিয়া যাইবার পর কালীপুরের চৌধুরীরা গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনিয়া শিবপুরে আসিয়া বাস করিয়াছিল। জ্ঞাতি সদ্গোপ চাষীদের প্রত্যক্ষ সংসব এড়াইবার জন্যই তাহারা এই ব্যবস্থা করিয়াছিল। চৌধুরীরাই শিবপুরকে একটি স্বতন্ত্র মৌজায় পরিণত করিয়াছিল। তাহাদের পতনের। সঙ্গে সঙ্গে আবার শিবপুর স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে।
উত্তর-পশ্চিমে যে গ্রামের মাঠ, সে গ্রামে নাকি লক্ষ্মী বসতি করেন না, গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে যে গ্রামের চাষের সীমানা—সেখানে নাকি লক্ষ্মীর অপার করুণা। অন্তত প্রবীণেরা তাই বলে। মাঠ উত্তর ও পশ্চিম দিকে হইলে দেখা যায় গ্রাম অপেক্ষা মাঠ উঁচু। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে ক্রমনিম্নতার একটা একটানা প্রবাহ চলিয়া গিয়াছে। বোধহয় গোটা পৃথিবী জুড়িয়া এইটাই এই ক্রমনিম্নতার জন্যই, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে কৃষিক্ষেত্র হইলে গ্রামের সমস্ত জলই গিয়া মাঠে পড়ে; গ্রাম-ধোঁয়া জলের উর্বরতা প্রচুর। ইহা ছাড়াও গ্রামের পুকুরগুলির জলের সুবিধা ষোল আনা পাওয়া যায়। এই কারণে শিবপুর এবং কালীপুর পাশাপাশি গ্রাম হইলেও দুই গ্রামের জমির গুণ ও মূল্যে অনেক প্রভেদ। এজন্য কালীপুরের লোকের অনেক অহঙ্কার শিবপুরের লোককে সহ্য করিতে হয়। শিবপুরের চৌধুরীরা এককালে তাহাদের জমিদার ছিল, তখন কালীপুরকে শিবপুরের আধিপত্য সহ্য করিতে হইয়াছে, কালীপুরের বর্তমান অহঙ্কারের ঔদ্ধত্য তাহারও একটা প্রতিক্রিয়া বটে।
দ্বারকা চৌধুরী সেই বংশোদ্ভূত। চৌধুরীদের সমৃদ্ধি অনেক দিনের কথা। দ্বারকা চৌধুরীর এক পুরুষ পূর্বে তাহাদের বংশের সম্মান-সমৃদ্ধির ভাণ্ডার নিঃশেষিত হইয়াছে। চৌধুরীরও আভিজাত্যের কোনো ভান নাই; পূর্বকালের কথা সে সম্পূর্ণ ভুলিয়া গিয়াছে। এ অঞ্চলের চাষীদের সঙ্গে সে সমানভাবেই মেলামেশা করে; এক মজলিসে বসিয়া তামাক খায়-সুখদুঃখের গল্প করে। তবু চৌধুরীর কথাবার্তার ধরন ও সুরের মধ্যে একটু স্বাতন্ত্র্য আছে। চৌধুরী কথা বলে খুব কম, যেটুকু বলে—তাহাও অতি ধীর এবং মৃদু স্বরে। কথার প্রতিবাদ করিলে চৌধুরী তাহার আর প্রতিবাদ করে না; কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীর কথা সংক্ষেপে স্বীকার করিয়া লয়, কোনো ক্ষেত্রে চুপ করিয়া যায়, কোনো ক্ষেত্রে সেদিনকার মত মজলিস হইতে উঠিয়া পড়ে। মোটকথা, চৌধুরী শান্তভাবেই অবস্থান্তরকে মানিয়া লইয়া জীবন অতিবাহিত করিয়া চলিয়াছে।
বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী সকালেই ছাতাটা মাথায়—বাঁশের লাঠিটি হাতে লইয়া কালীপুরের দক্ষিণ মাঠে নদীর ধারে রবি-ফসলের চাষের তদ্বিরে চলিয়াছিল। কালীপুরের জমিদারির স্বত্ব চলিয়া গেলেও সেখানে তাদের মোটা জোত এখনও আছে। কালীপুরের দক্ষিণেই অমরকুণ্ডার মাঠ, পূর্বেই বলিয়াছি, এখানকার ফসল কখনও মরে না, এ মাঠে হাজা-সুখা নাই। মাঠটির মাথায় বেশ বিস্তৃত দুইটি ঝরনার, জল আছে; প্রশস্ত একটি অগভীর জলা হইতে নালা বাহিয়া অবিরাম জল বহিয়া চলিয়াছে; জলাটি কানায় কানায় অহরহই পরিপূর্ণ, জল কখনও শুকায় না। এই যুগ-ধারাই অমরকুণ্ডার মাঠের উপর যেন ধরিত্রীমাতার বক্ষক্ষরিত ক্ষীরধারা। নালা বাহিয়া জলাভাবের সময় নালায় বাঁধ দিয়া, যাহার যে দিকে প্রয়োজন জলস্রোতকে ঘুরাইয়া। লইয়া যায়।
অগ্রহায়ণ পড়িতেই হৈমন্তী ধান পাকিতে শুরু করিয়াছে, সবুজ রঙ হলুদ হইতে আরম্ভ করিয়াছে। অমরকুণ্ডার মাঠের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত নদীর বাঁধের কোল পর্যন্ত সুপ্রচুর ধানের সবুজ ও হলুদ রঙের সমন্বয়ে রচিত অপূর্ব এক বর্ণশোভা ঝলমল করিতেছে। ধানের। প্রাচুর্যে মাঠের আল পর্যন্ত কোথাও দেখা যায় না। কেবল ঝরনার দুই পাশের বিসৰ্পিল বাঁধের উপরের তালগাছগুলি অ্যাঁকাবাঁকা সারিতে ঊর্ধ্বলোকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হেমন্তের পীতাভ রৌদ্রে মাঠখানা ঝলমল করিতেছে। আকাশে আজও শরতের নীলের আমেজ রহিয়াছে; এখনও ধূলা উড়িতে আরম্ভ করে নাই। দূরে আবাদি মাঠের শেষ প্রান্তে নদীর বন্যারোধী বাঁধের উপর ঘন সবুজ শরবন একটা সবুজ রঙের দীর্ঘ প্রাচীরের মত দাঁড়াইয়া আছে। মাথায় চুনকাম করা আলিসার মত চাপ বাঁধিয়া সাদা ফুলের সমৃদ্ধ সমারোহ বাতাসে অল্প অল্প দুলিতেছে।
কালীপুরের পশ্চিম দিকে–সম্ভ্রান্ত ধনীদের গ্রাম কঙ্কণা; গ্রামের চারিপাশের গাছপালার উপর সাদা-লাল-হলুদ রঙের দালানগুলির মাথা দেখা যাইতেছে। একেবারে ফাঁকা প্রান্তরে স্কুল—হাসপাতাল–বাবুদের থিয়েটারের ঘর আগাগোড়া পরিষ্কার দেখা যায়। বাবুরা হালে টাকায় এক পয়সা ঈশ্বরবৃত্তির প্রচলন করিয়াছেন; টাকা দিতে গেলেও দিতে হইবেটাকা লইতে গেলেও দিতে হইবে। ওই টাকায় পার্বণ-উপলক্ষে ধুমধাম যাত্রা-থিয়েটার হয়। চৌধুরী নিশ্বাস ফেলিল-দীর্ঘনিশ্বাস। বৎসরে দেড় টাকা দুই টাকা করিয়া তাহাকে ওই ঈশ্বরবৃত্তি দিতে হয়।