ডাক্তার বলিল জানি। কিন্তু দারোগা টাকা খেলে—তারও উপায় আছে। তার ওপরে। কমিশনার আছে। তার ওপরে ছোট লাট, ঘোট লাটের ওপর বড় লাট আছে।
অনিরুদ্ধ বলিলতা বুঝলাম ডাক্তারবাবু, কিন্তু মেয়েছেলেকে এজাহার-ফেজাহার দিতে হবে, সেই কথা আমি ভাবছি।
—মেয়েছেলের এজাহার? ডাক্তার আশ্চর্য হইয়া গেল। মাঠে ধান চুরি হয়েছে, তাতে মেয়েছেলেকে এজাহার দিতে হবে কেন? কে বলল? এ কি মগের মুলুক নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ উঠিয়া পড়িল।—তা হলে আমি আজ্ঞে এই এখুনি চললাম।
ডাক্তার বাইসাইকেলে উঠিয়া বলিল, যা, তুই নির্ভাবনায় চলে যা। আমি ওবেলা যাব। চুরি করার জন্যে ধান কেটে নিয়েছে—এ কথা বলবি না, বলবি, আক্রোশবশে আ সার ক্ষতি করবার জন্যে করেছে।
অনিরুদ্ধ আর বাড়ির মধ্যে ঢুকি না পর্যন্ত, রওনা হইয়া গেল, পাছে পদ্ম আবার বাধা দেয়। সে ডাক্তারের গাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই চলিতে আরম্ভ করিল; গিরিশকে বলিল—গিরিশ, কামারশালের চাবিটা নিয়ে এসো তো ভাই চেয়ে।
ওপারের জংশনের কামারশালের চাবি। গিরিশকে ভিতরে ঢুকিয়া চাহিতে হইল না, দরজার আড়াল হইতে ঝনাৎ করিয়া চাবিটা আসিয়া তাহার সম্মুখে পড়িল। গিরিশ হেঁট হইয়া চাবিটা তুলিতেছিল–পদ্ম দরজার পাশ হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল—ডাক্তার ও অনিরুদ্ধ অনেকখানি চলিয়া গিয়াছে। সে এবার আধঘোমটা টানিয়া সামনে আসিয়া বলিল—একবার ডাক ওকে।
মুখ তুলিয়া একবার পদ্মের দিকে একবার অনিরুদ্ধের দিকে চাহিয়া গিরিশ বলিল—পেছনে ডাকলে ক্ষেপে যাবে।
–তা তো যাবে। কিন্তু ভাত? ভাত নিয়ে যাবে কে? আজ কি খেতেদেতে হবে না?
গিরিশ ও অনিরুদ্ধ সকালে উঠিয়া ওপারে যায়, তাহার পূর্বেই তাহাদের ভাত হইয়া থাকে যাইবার সময় সেই ভাত তাহারা একটা বড় কৌটায় করিয়া লইয়া যায়। সেই খাইয়াই তাহাদের দিন কাটে। রাত্রে খাওয়াটা বাড়িতে ফিরিয়া আরাম করিয়া খায়। গিরিশ বলিল–ভাতের কৌটা আমাকে দাও, আমিই নিয়ে যাই।
* * *
পদ্ম সংসারে একা মানুষ। বছর দুয়েক পূর্বে শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর হইতেই সমস্ত দিনটা তাহাকে একলাই কাটাইতে হয়। সে নিজে বন্ধ্যা, ছেলেপুলে নাই। পাড়াগাঁয়ে এমন অবস্থায় একটি মনোেহর কর্মান্তর আছে—সে হইল পাড়া বেড়ানো। কিন্তু পদ্মের স্বভাব যেন উৰ্ণনাভগৃহিণীর মত। সমস্ত দিনই সে আপনার গৃহস্থালির জাল ক্রমাগত বুনিয়া চলিয়াছে। ধান-কলাই রৌদ্রে দিতেছে, সেগুলি তুলিতেছে, মাটি ও কুড়ানো ইট দিয়া গাঁথিয়া ঘরে বেদি বাঁধিতেছে; ছাই দিয়া মাজিয়া-তোলা বাসনেরও ময়লা তুলিতেছে—শীতের লেপ-কাঁথাগুলি পাড়িয়া নতুন পাট করিতেছে। ইহা ছাড়া নিয়মিত কাজ–গোয়াল পরিষ্কার করা, জাব কাটা, ঘুঁটে দেওয়া, তিন-চারবার বাড়ি ঝট দেওয়া এসব তো আছেই।
আজ কিন্তু তাহার কোনো কাজ করিতে ইচ্ছা হইল না। সে খিড়কির ঘাটে পা ছড়াইয়া বসিল। অনিরুদ্ধকে থানায় যাইতে বারণ করিয়াছে, হাসিমুখে রহস্য করিয়া তাহাকে শান্ত করিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছে—সে কেবল ভবিষ্যৎ অশান্তি নিবারণের জন্য। ঐ দু বিঘা বাকুড়ির ধানের জন্য তাহারও দুঃখের সীমা ছিল না। আপন মনেই সে মৃদুস্বরে ছিরু পালকে অভিসম্পাত দিতে শুরু করিল।
কানা হবেন—কানা হবেন—অন্ধ হবেন;হাতে কুষ্ঠ হবে,সর্বস্ব যাবে ভিক্ষে করে খাবেন।
সহসা যেন কোথাও প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে বলিয়া মনে হইল। পদ্ম কান পাতিয়া শুনিল। গোলমালটা বায়েনপাড়ায় মনে হইতেছে। প্রচণ্ড রূঢ়কণ্ঠে অশ্লীল ভাষায় কেউ তর্জন-গর্জন করিতেছে। ওই ছোঁয়াচটা যেন পদ্মকেও লাগিয়া গেল। সেও কণ্ঠ উচ্চে চড়াইয়া শাপ-শাপান্ত আরম্ভ করিল—
—জোড়া বেটা ধড়ফড় করে মরবে; এক বিছানায় একসঙ্গে। আমার জমির ধানের চালে কলেরা হবে। নিবংশ হবেন নিবংশ হবেন; নিজে মরবেন না, কানা হবেন—দুটি চোখ যাবে, হাতে কুষ্ঠ হবে। যথাসর্বস্ব উড়ে যাবে পুড়ে যাবে। পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবেন।
বেশ হিসাব করিয়াছিরু পালের সহিত মিলাইয়া সে শাপ-শাপান্ত করিতেছিল। সহসা তাহার নজরে পড়িল, খিড়কির পুকুরের ওপারে রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া ছিরু পাল তাহার গালিগালাজগুলি বেশ উপভোগ করিয়া হাসিতেছে। এইমাত্র ছিরু পাতু বায়েনকে মারপিট করিয়া ফিরিতেছিল, বায়েনপাড়ার কলরবটা তাহারই সেই বিক্রমোদ্ভূত। ফিরিবার পথে অনিরুদ্ধের স্ত্রীর শাপ-শাপান্ত শুনিয়া দাঁড়াইয়া হাসিতেছিল। সে হাসির মধ্যে বন্য একটা ক্রুর প্রবৃত্তির প্রেরণা অথবা তাড়নাও ছিল। দেখিয়া পদ্ম উঠিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। ছিরু ভাবিতেছিল, লাফ দিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবে কি না? কিন্তু দিবালোককে তাহার বড় ভয়, সে স্পন্দিতবক্ষে দ্বিধা করিতেছিল। সহসা পদ্মের কণ্ঠস্বর শুনিয়া আবার সে ফিরিয়া চাহিল; কিন্তু কিসের একটা প্রতিবিম্বিত আলোকচ্ছটা তাহার চোখে আসিয়া পড়িতেই সে চোখ ফিরাইয়া লইল।
—ধার পরীক্ষ করতে এক কোপে দুটো পাটা কেটে আমার কাজ বাড়িয়ে গেলেন। বীরপুরুষ; রক্তের দাগ ধোঁয়া নাই—ঘরে ভরে রেখে দিয়েছেন। আমি ঘাটে বসে ঝামা ঘষি আর কি!
পদ্মের হাতে একখানা বগি দা; রোদ পড়িয়া দাখানা ঝকঝক করিতেছে। তাহারই ছটা আসিয়া চোখে পড়িতেই ছিরু পাল চোখ ফিরাইয়া লইল। পরক্ষণেই দুমদুম্ শব্দে পা ফেলিয়া আপনার বাড়ির পথ ধরিল। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মের মুখেও নিষ্ঠুর কৌতুকের হাসি ফুটিয়া উঠিল।
০৪. বিস্তীর্ণ পঞ্চগ্রামের মাঠ
গ্রাম হইতে বাহির হইলেই বিস্তীর্ণ পঞ্চগ্রামের মাঠ। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় মাইল প্রস্থে চার মাইল; কঙ্কণা, কুসুমপুর, মহাগ্রাম, শিবকালীপুর ও দেখুড়িয়া এই পাঁচখানা গ্রামের অবস্থিতি; এবং পাঁচখানা গ্রামের সীমানার মাঠ ময়ূরাক্ষী নদীর ধার পর্যন্ত ছড়াইয়া আছে। মাঠখানার দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ তিন দিকে ময়ূরাক্ষী নদী। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরভূমি জুড়িয়া এই মাঠখানার উর্বরতা অদ্ভুত। অংশের নামই হইল অমরকুণ্ডার মাঠ অর্থাৎ মাঠে ফসলের মৃত্যু নাই। শিবপুরের ইহার মধ্যে আবার শিবকালীপুরের সীমানার জমিই নাকি উৎকৃষ্ট। এইটুকু জমির পরিমাণ এদিকে অতি অল্প; শিবপুরের সমস্ত জমি উত্তর দিকে। কালীপুরের চাষের মাঠ অধিকাংশই গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে অর্থাৎ এই দিকে। শিবকালীপুর নামেমাত্র দুইখানা গ্রাম; শিবপুর ও কালীপুর, দুই গ্রামে বসতির মধ্যে কেবল একটা দিঘির ব্যবধান। কালীপুর গ্রামখানাই বড়, ওই গ্রামেই লোকসংখ্যা বেশি; শ্রীহরি, দেবু প্রভৃতি সকলেরই বাস এখানে।