—হুঁ। চিন্তিতভাবে হুঁকায় গোটাকয়েক টান দিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—কিন্তু এর একটা বিহিত করতে তো হবে। আজ না হয় দু বিঘে জমির ধান গেল। কাল আবার পুকুরের মাছ ধরে নেবে–পরশু ঘরে–
বাধা পড়িল অনি-ভাই ঘরে রয়েছ নাকি? অনিরুদ্ধের কথা শেষ হইবার পূর্বেই বাহির হইতে গিরিশ ডাকিয়া সাড়া দিয়া বাড়ির মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিলা পদ্ম আধঘোমটা টানিয়া, এঁটো বাসন কয়খানি তুলিয়া ঘাটের দিকে চলিয়া গেল।
অনিরুদ্ধ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-দু বিঘে বাকুড়িয়া ধান একেবারে শেষ করে কেটে নিয়েছে, একটি শীষও পড়ে নাই।
গিরিশও একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—শুনলাম।
—থানায় ডায়রি করব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু বউ বারণ করছে। বলছে, ছিরু পাল চুরি করেছে—এ কথা বিশ্বাস করবে কেন? আর গায়ের লোকও আমার হয়ে কেউ সাক্ষি দেবে না।
–হ্যাঁ; কাল সন্ধেতে আবার নাকি চণ্ডীমণ্ডপে জটলা হয়েছিল। আমরা নাকি অপমান করেছি। গায়ের লোকদের। জমিদারের কাছে নালিশ করবে শুনছি।
ঠোঁটের দিক বাঁকাইয়া অনিরুদ্ধ এবার বলিয়া উঠিল—যা যা! জমিদার, জমিদার আমার কচু করবে।
কথাটা গিরিশের খুব মনঃপূত হইল না, সে বলিল—তাই বলারই বা আমাদের দরকার কি? জমিদারেরও তো বিচার আছে, তিনি বিচার করুন না কেন?
অনিরুদ্ধ বারবার ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল—সঁহ, ছাই বিচা. করবে জমিদার। নিজেই আজ তিন বছর ধান দেয় নাই। জমিদার ঠিক ওদের রায়ে রায় দেবে; তুমি জান না।
বিষণ্ণভাবে গিরিশ বলিল-আমিও পাই নাই চার বছর।
অনিরুদ্ধ বলিল—এই দেখ ভাই, যখন মুখ ফুটে বলেছি কব না তা তখন আমার মরাবাবা এলেও আমাকে করাতে পারবে না; তাতে আমার ভাগ্যে যাই থাক! তুমি ভাই এখনও বুঝে দেখ।
গিরিশ বলিল—সে তুমি নিশ্চিন্দি থাক। তুমি না মিটোলে আমি মিটোব না।
অনিরুদ্ধ প্রীত হইয়া কল্কেটি তাহার হাতে দিল। গিরিশ হাতের ছাদের মধ্যে কক্িেট পুরিয়া কয়েক টান দিয়া বুলিল—এদিকে গোলমালও তোমার চরম লেগে গিয়েছে; শুধু আমরা দুজনা নই। জমিদার কজনার বিচার করবে, করুক না! নাপিত, বায়েন, দাই, চৌকিদার, নদীর ঘাটের মাঝি, মাঠ-আগলদার সবাই আমাদের ধুয়ো নিয়ে ধুয়ে ধরেছে—ওই অল্প ধান নিয়ে আমরা কাজ করতে পারব না। তারা নাপিত তো আজই বাড়ির দোরে অর্জুনতলায় খানকয়েক ইট পেতে বসেছে—বলে পয়সা আন, এনে কামিয়ে যাও।
অনিরুদ্ধ কল্কেটি ঝাড়িয়া নূতন করিয়া তামাক সাজিতে সাজিতে বলিল—তাই বৈকি! পয়সা ফেল, মোওয়া খাও; আমি কি তোমার পর?
গিরিশের কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটি বিজ্ঞতা-প্রচারের ভঙ্গি থাকে, ইহা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে; সে বলিল—এই কথা! আগেকার কাল তোমার এক আলাদা কথা ছিল। সস্তাগণ্ডার। বাজার ছিল—তখন ধান নিয়ে কাজ করে আমাদের পুষিয়েছে—আমরা করেছি; এখন যদি না। পোষায়?
বাহিরে রাস্তায় ঠুনঠুন করিয়া বাইসাইকেলের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল; সঙ্গে সঙ্গে ডাক। আসিল– অনিরুদ্ধ।
ডাক্তার জগন্নাথ ঘোষ।
অনিরুদ্ধ ও গিরিশ দুজনেই বাহির হইয়া আসিল। মোটাসোটা খাটো লোকটি, মাথায় বাবরি চুল—জগন্নাথ ঘোষ বাইসাইকেল ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ডাক্তার কোথাও পড়িয়া-শুনিয়া পাস করে নাই, চিকিৎসাবিদ্যা তাহাদের তিন পুরুষের বংশগত বিদ্যা; পিতামহ ছিলেন কবিরাজ, বপ জ্যেঠা ছিলেন কবিরাজ এবং ডাক্তার একাধারে দুই। জগন্নাথ কেবল ডাক্তার, তবে সঙ্গে দু-চারটি মুষ্টিযোগের ব্যবস্থাও দেয়—তাহাতে চট্ করিয়া ফলও হয় ভাল। গ্রামের সকল লোকই তাহাকে দেখায়, কিন্তু পয়সা বড় কেহ দেয় না। ডাক্তার তাহাতে খুব গররাজি নয়, ডাকিলেই যায়, বাকির উপরে বাকিও দেয়। ভিন্ন গ্রামেও তাহাদের পুরুষানুক্ৰমিক পসার আছে—সেখানকার রোজগারেই তাহার দিন চলে। কোনোদিন শাক-ভাত, আর কোনোদিন যাহাকে বলে এক-অন্ন পঞ্চাশ-ব্যঞ্জন, যেদিন যেমন রোজগার। এককালে ঘোষেরা সম্পত্তিশালী প্রতিষ্ঠাবান লোক ছিল। ধনীর গ্রাম কঙ্কণায় পর্যন্ত যথেষ্ট সম্মান-মর্যাদা পাইত, কিন্তু ওই কঙ্কণার লক্ষপতি মুখুজ্জেদের এক হাজার টাকা ঋণ ক্ৰমে চারি হাজারে পরিণত হইয়া ঘোষেদের সমস্ত সম্পত্তি গ্ৰাস করিয়া ফেলিয়াছে। এই সম্পত্তি এবং সকলের সম্মানিত প্রবীণগণের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের সেই সম্মান-মর্যাদাও চলিয়া গিয়াছে। জগন্নাথ অকাতরে চিকিৎসা এবং ঔষধ সাহায্য করিয়াও সে সম্মান আর ফিরিয়া পায় নাই। তাহার জন্য তাহার ক্ষোভের অন্ত নাই। সেই ক্ষোভে কাহাকেও রেয়াত করে না, রূঢ়তম ভাষায় সে উচ্চকণ্ঠে বলে—চোরের দল সব, জানোয়ার। গোপনে নয়, সাক্ষাতেই বলে। ধনী দরিদ্র যেই হোক প্রত্যেকের ক্ষুদ্রতম অন্যায়েরও অতি কঠিন প্রতিবাদ সে করিয়া থাকে। তবে স্বাভাবিকভাবে ধনীদের ওপর ক্রোধ তাহার বেশি।
অনিরুদ্ধ ও গিরিশ বাহির হইয়া আসিতেই ডাক্তার বিনা ভূমিকায় বলিল—থানায় ডায়রি করলি?
অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে তাই–
—তাই আবা। কিসের রে বাপু? যা, ডায়রি করে আয়।
–আজ্ঞে বারণ করছে সব, বলছে—ছিরু পাল চুরি করেছে কে এ কথা বিশ্বাস করবে?
–কেন? ও বেটার টাকা আছে বলে?
–তাই তোতা সাত-পাঁচ ভাবছি ডাক্তারবাবু।
বিদ্ৰুপতীক্ষ্ণ হাসি হাসিয়া জগন্নাথ বলিলতা হলে এ সংসারে যাদের টাকা আছে তারাই সাধু—আর গরিব মাত্ৰেই অসাধু, কেমন? কে বলেছে এ কথা?
অনিরুদ্ধ এবার চুপ করিয়া রহিল। বাড়ির ভিতরে বাসনের টুংটাং শব্দ উঠিতেছে। পদ্ম ফিরিয়াছে, সব শুনিতেছে, তাহারই ইশারা দিতেছে। উত্তর দিল গিরিশ, বলিল-আজ্ঞে, ডায়রি করেই বা কি হবে ডাক্তারবাবু, ও এখুনি টাকা দিয়ে দারোগার মুখ বন্ধ করবে। তা ছাড়া থানার জমাদারের সঙ্গে ছিরু র বেশ ভাবের কথা তো জানেন! একসঙ্গে মদ-ভাং খায়—তারপর