শ্ৰীহরির বিশাল দেহ কিন্তু স্থূল নয়, একবিন্দু মেদশৈথিল্য নাই। বাঁশের মত মোটা হাতপায়ের হাড়—তাহাতে জড়ানো কঠিন মাংসপেশী। প্রকাণ্ড চওড়া দুখানা হাতের পাঞ্জা, প্রকাণ্ড বড় মাথা, বড় বড় উগ্র চোখ, থ্যাবড়া নাক, আকর্ণ-বিস্তার মুখগহ্বর, তাহার উপর একমাথা কোঁকড়াঝাঁকড়া চুল। এত বড় দেহ লইয়া সে কিন্তু নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দ্রুত চলিতে পারে। পরের ঝাড়ের বাঁশ কাটিয়া সে রাতারাতি আনিয়া আপনার পুকুরে ফেলিয়া রাখে, শব্দ নিবারণের জন্য সে হাত-করাত দিয়া বাণ কাটে। খেপলা জাল ফেলিয়া রাত্রে সে পরের পুকুরের পোনামাছ আনিয়া নিজের পুকুর বোঝাই করে; প্রতি বৎসর তাহার বাড়ির পাঁচিল সে নিজেই বর্ষার সময় কোদাল চালাইয়া ফেলিয়া দেয়, নতুন পাচিল দিবার সময় অপরের সীমানা অথবা রাস্তা খানিকটা চাপাইয়া লয়। কেহ বড় প্রতিবাদ করে না, কিন্তু ব্যক্তিগত সীমানা আত্মসাৎ করিলে প্রতিবাদ না করিয়া উপায় থাকে না। তখন ছিরু কোদাল হাতেই উঠিয়া দাঁড়ায়; দন্তহীন মুখে কি বলে বোঝা যায় না। মনে হয় একটা পশু গৰ্জন করিতেছে। এই চুয়াল্লিশ বৎসর বয়সেই সে দন্তহীন, যৌনব্যাধির আক্রমণে তাহার দাঁতগুলো প্রায় সবই পড়িয়া গিয়াছে। হরিজন-পল্লীতে সন্ধ্যার পর যখন পুরুষেরা মদে বিভোর হইয়া থাকে, তখন ছিকু নিঃশব্দ পদসঞ্চারে শিকার ধরিতে প্রবেশ করে। কতবার তাহারা উহাকে তাড়া করিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছে—কিন্তু ছিরু ছুটিয়া চলে অন্ধকারচারী হিংস্র চিতাবাঘের মত।
এই শ্ৰীহরি ঘোষ, ওরফে ছিরু পাল বা ছিরে মোড়ল।
শ্ৰীহরিকে ভাল করিয়া চিনিয়াও অনিরুদ্ধ স্ত্রীর কথা বিবেচনা করা দূরে থাক, তাহাকে ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া, বাড়ি হইতে রাস্তায় নামিয়া পড়িল। পদ্ম বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে রাগ অভিমান করিল না, আবার ডাকিল—ওগো, শোনোন, ফেরো। অনিরুদ্ধ ফিরিল না।
এবার একটু ক্ষীণ হাসিয়া পদ্ম ডাকিল—পেছন ডাকছি, যেও না, শোন!
সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ লাঙুলসৃষ্ট কেউটের মত সক্রোধে ফিরিয়া দাঁড়াইল।
পদ্ম হাসিয়া বলিল—একটু জল খেয়ে যাও।
অনিরুদ্ধ ফিরিয়া আসিয়া পদ্মের গালে সজোরে এক চড় বসাইয়া দিয়া বলিল—ডাকবি আর পিছন থেকে?
পদ্মের মাথাটা ঝিনঝিন করিয়া উঠিল, অনিরুদ্ধের লোহাপেটা হাতের চড়–নিদারুণ আঘাত। পদ্ম বাবা রে বলিয়া হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িল।
অনিরুদ্ধ এবার অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে একটু ভয়ও হইল। যেখানে-সেখানে চড় মারিলে নাকি মানুষ মরিয়া যায়; সে ত্রস্ত হইয়া ডাকিল পদ্ম! পদ্ম! বউ!
পদ্মের শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে—সে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে। অনিরুদ্ধ বলিল–এই নে বাপু, এই নে জামা খুললাম, থানায় যাব না। ওঠ। কাঁদিস না, ও পদ্ম।…সে পদ্মের মুখ-ঢাকা হাতখানি ধরিয়া টানিলও পদ্ম!
পদ্ম এবার মুখ হইতে হাত ছাড়িয়া দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; মুখ ঢাকা দিয়া পদ্ম কাঁদে নাই, নিঃশব্দে হাসিতেছিল। অদ্ভুত শক্তি পদ্মের; আর অনিরুদ্ধের অনেক কিল চড় খাওয়া তাহার অভ্যাস আছে-এক চড়ে তাহার কি হইবে।
কিন্তু অনিরুদ্ধের পৌরুষে বোধহয় ঘা লাগিল—সে গুম হইয়া বসিয়া রহিল। পদ্ম খানিকটা গুড় আর প্রকাণ্ড একটা বাটিতে এক বাটি মুড়ি ও টুনি ঘটির এক ঘটি জল আনিয়া নামাইয়া দিয়া বলিল—তুমি ছিরু মোড়লকে সুবে করে এজাহার করবে, গায়ের লোক কে তোমার হয়ে সাক্ষি দেবে বল তো? কাল থেকে তো গায়ের লোক সবাই তোমার ওপর বিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাল সন্ধ্যার পর আবার মজলিস বসিয়াছিল, অনিরুদ্ধের ওই মজলিসকে মানি না কথাটা সকলকে বড় আঘাত দিয়াছে। সন্ধ্যার মজলিসে অনিরুদ্ধ এবং গিরিশের বিরুদ্ধে জমিদারের কাছে নালিশ জানানো স্থির হইয়া গিয়াছে।
কথাটা অনিরুদ্ধের মনে পড়িল, কিন্তু তবু তাহার মন মানিল না।
০৩. এক ছিলিম তামাক
বেশ পরিপাটি করিয়া এক ছিলিম তামাক সাজিয়া হুঁকায় জল ফিরাইয়া পদ্ম স্বামীর আহারশেষের প্রতীক্ষা করিতেছিল। অনিরুদ্ধের খাওয়া শেষ হইতেই হাতে জল তুলিয়া দিয়া কাটি। তাহার হাতে দিয়া বলিলখাও। অনিরুদ্ধ টানিয়া বেশ গলগল করিয়া নাক-মুখ দিয়া ধোঁয়া বাহির করিয়াছে, তখন পদ্ম বলিল—আমার কথাটা ভেবে দেখ। রাগ একটু পড়েছে তো?
—রাগ! অনিরুদ্ধ মুখ তুলিয়া চাহিল—ঠোঁট দুইটা তাহার থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।–এ রাগ আমার তুষের আগুন, জনমে নিববে না। আমার দু বিঘে বাকুড়ির ধান–
কথাটা শেষ করিতে পারিল না। কারণ তাহার চোখের জলের ছোঁয়াচে পদ্মের ডাগর চোখ দুটিও অজলে উজ্জসিত হইয়া উঠিয়াছে। এবং অনিরুদ্ধের আগেই তাহার ফোঁটা কয়েক জল টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল।
অনিরুদ্ধ চোখ মুছিয়া বলিল—কাঁদছিস কেন তুই? দু বিঘে জমির ধান গিয়েছে, যাগে। আমি তো আছিরে বাপু! আর দেখ না—কি করি আমি!
চোখ মুছিতে মুছিতে পদ্ম বলিল—কিন্তু থানা-পুলিশ কোরো না বাপু! তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি। ওরা সাপ হয়ে দংশায়, রোজা হয়ে ঝাড়ে। আমার বাপের ঘরে ডাকাতি হল-বাবা চিনলে এক জনকে কিন্তু পুলিশ তার গায়ে হাত দিল না। অথচ মুঠো-মুঠো টাকা খরচ হয়ে গেল বাবার। ছেলেমেয়ে গুষ্টি সমেত নিয়ে টানাটানি; একবার দারোগা আসে, একবার নেসপেকটার আসে, একবার সায়েব আসে আর দাও এজাহার। তার পরে, কজনকে কোথা হতে ধরলে, তাদিগে শনাক্ত করতে জেলখানা পর্যন্ত মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি। তাছাড়া গালমন্দ আর ধমক তো আছেই।