চৌধুরী এবার চাদরখানি ঘাড়ে ফেলিয়া বাঁশের লাঠিটা লইয়া উঠিল; বলিল—চললাম গো তা হলে। ব্রাহ্মণগণকে প্রণাম—আপনাদিগে নমস্কার।
এই সময়ে গ্রামের পাতুলাল মুচি জোড়হাত করিয়া আগাইয়া আসিয়া বলিল চৌধুরী মহাশয়, আমার একটুকুন বিচার করে দিতে হবে।
চৌধুরী সন্তৰ্পণে মজলিস হইতে বাহির হইবার উদ্যোগ করিয়া বলিলবল বাবা, এরা সব। রয়েছেন, বল!
–চৌধুরী মশায়!
চৌধুরী এবার চাহিয়া দেখিল—অনিরুদ্ধ আবার ফিরিয়া আসিয়াছে।
—একবার বসতে হবে চৌধুরী মশায়! ছিরু পালের টাকাটা আমি এনেছি—আপনারা থেকে কিন্তু আমার হ্যান্ডনোটটা ফেরতের ব্যবস্থা করে দিন।
মজলিসসুদ্ধ লোক এতক্ষণে সচেতন হইয়া চৌধুরীকে ধরিয়া বসিল। কিন্তু চৌধুরী কিছুতেই নিরস্ত হইল না, সবিনয়ে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
অনিরুদ্ধ পঁচিশ টাকা দশ আনা মজলিসের সম্মুখে রাখিয়া বলিল—এখনই হ্যান্ডনোটখানা। নিয়ে এস ছিরু পাল!
পরে হ্যান্ডনোটখানি ফেরত লইয়া বলিল–ও একটা পয়সা আমাকে আর ফেরত দিতে হবে। না। পান কিনে খেয়ো। এস হে গিরিশ, এস।
হরিশ বলিল—ওই, তোমরা চললে যে হে? যার জন্যে মজলিস বসল—
অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা আর ও কাজ করব না মশায়, জবাব দিলাম। যে মজলিস ছিরু মোড়লকে শাসন করতে পারে না, তাকে আমরা মানি না।
তাহারা হনহন করিয়া চলিয়া গেল। মজলিস ভাঙিয়া গেল।
পরদিন প্রাতেই শোনা গেল, অনিরুদ্ধের দুই বিঘা বাকুড়ির আধ-পাকা ধান কে বা কাহারা নিঃশেষে কাটিয়া তুলিয়া লইয়াছে।
০২. ফসলশূন্য ক্ষেত্ৰখানা
অনিরুদ্ধ ফসলশূন্য ক্ষেত্ৰখানার আইলের উপর স্থিরদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ দেখিল। নিম্ফল আক্ৰোশে তাহার লোহা-পেটা হাত দুখানা মুঠা বাঁধিয়া ডাইসযন্ত্রের মত কঠোর করিয়া তুলিল। তাহার পর সে অত্যন্ত দ্রুতপদে বাড়ি ফিরিয়া হাতকাটা জামাটা টানিয়া সেটার মধ্যে মাথা গলাইতে গলাইতে বাহির দরজার দিকে অগ্রসর হইল।
অনিরুদ্ধের স্ত্রীর নাম পদ্মমণিদীর্ঘাঙ্গী পরিপূর্ণ-যৌবনা কালো মেয়েটি। টিকালো নাক, টানা-টানা ভাসা-ভাসা ডাগর দুটি চোখ। পদ্মের রূপ না থাক, শ্ৰী আছে। পদ্মের দেহে অদ্ভুত শক্তি, পরিশ্রম করে সে উদয়াস্ত। তেমনি তীক্ষ্ণ তাহার সাংসারিক বুদ্ধি। অনিরুদ্ধকে এইভাবে বাহির হইতে দেখিয়া সে স্বামী অপেক্ষাও দ্রুতপদে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল—চললে কোথায়?
রূঢ়দৃষ্টিতে চাহিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—ফিঙের মত পেছনে লাগলি কেন? যেখানে যাই না, তোর সে খোঁজে কাজ কি?
হাসিয়া পদ্ম বলিল—পেছনে লাগি নাই। তার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আর, খোঁজে আমার দরকার আছে বৈকি। মারামারি করতে যেতে পাবে না তুমি।
অনিরুদ্ধ বলিল-মারামারি করতে যাই নাই, থানা যাচ্ছি, পথ ছাড়।
–থানা? পদ্মর কণ্ঠস্বরের মধ্যে উদ্বেগ পরিস্ফুট হইয়া উঠিল।
–হ্যাঁ, থানা। শালা ছিরে চাষার নামে আমি ডাইরি করে আসব। রাগে অনিরুদ্ধের কণ্ঠস্বর রণ-রণ করিতেছিল।
পদ্ম স্থিরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলনা। সত্যি হলেও ছিরু মোড়ল তোমার ধান চুরি করেছে—এ চাকলায় কে এ কথা বিশ্বাস করবে?
অনিরুদ্ধের কিন্তু তখন এ পরামর্শ শুনিবার মত অবস্থা নয়, সে ঠেলিয়া পদ্মকে সরাইয়া। দিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিল।
অনিরুদ্ধের অনুমান অভ্রান্ত,ধান শ্ৰীহরি পালই কাটিয়া লইয়াছে।
কিন্তু পদ্ম যাহা বলিয়াছে সে-ও নিষ্ঠুরভাবে সত্য, ধনীকে চোর প্রতিপন্ন করা বড় সহজ। নয়। শ্ৰীহরি ধনী।
এ চাকলায় কাছাকাছি তিনখানা গ্রাম—কালীপুর, শিবপুর ও কঙ্কণা-এ তিনখানা গ্রামে ছি পাল বা শ্রীহরি পালের ধনের খ্যাতি যথেষ্ট। কালীপুর ও শিবপুর সরকারি সেরেস্তায় দুখানা ভিন্ন। গ্রাম হিসাবে জমিদারের অধীন স্বতন্ত্র মৌজা হইলেও কার্যত একখানাই গ্রাম। একটা দিঘির এপারওপার মাত্র। শ্ৰীহরির বাস এই কালীপুরে। এ দুখানা গ্রামের মধ্যে শ্ৰীহরির সমকক্ষ ব্যক্তি আর কেহ নাই। শিবপুরের হেলা চাটুজ্জেরও টাকা ও ধান যথেষ্ট; তবে লোকে বলে—শ্ৰীহরির ঘরে সোনার ইট আছে, টাকা ধানও প্রচুর, তা হইলেও দুইজনের তুলনা হয় না। ক্রোশখানেক দূরবর্তী কঙ্কণা অবশ্য সমৃদ্ধ গ্রাম। বহু সম্ৰান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস। সেখানকার মুখুজ্জেবাবুরা লক্ষ লক্ষ টাকার অধিকারী এ অঞ্চলের প্রায় গ্রামই এখন তাহাদের কুক্ষিগত। মহাজন হইতে তাহারা প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার হইয়া উঠিয়াছে; শিবপুর কালীপুর গ্রাম দুখানাও ধীরে ধীরে তাহাদের গ্রামের আকর্ষণে সর্পিল জিহ্বার দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। কিন্তু সেখানেও শ্ৰীহরি পালের নামডাক আছে। ময়ূরাক্ষীর ওপারে আধা শহর রেলওয়ে জংশন, সেখানে ধনী মারোয়াড়ীর গদি আছে—দশবারটা চালের কল, গোটা দুয়েক তেল-কল, একটা আটার কল আছ—সেখানেও শ্ৰীহরি পালকে ঘোষ মশায় বলিয়াই সম্বর্ধিত করা হয়। ওই জংশন-শহরেই এ অঞ্চলের থানা অবস্থিত।
সুতরাং পদ্মের অনুমানের ভিত্তি আছে। কঙ্কণায় অথবা জংশন-শহরে কেহ এ কথা বিশ্বাস করিবে না; কিন্তু শিবকালীপুরের কেহ এ কথা অবিশ্বাস করে না। হিরু ভয়ঙ্কর ব্যক্তি এ সংসারে তাহার অসাধ্য কিছু নাই! এ ধান কাটিয়া লওয়া তাহার অনিরুদ্ধের উপর প্রতিশোধ লইবার জন্যই নয়—চুরিও তাহার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ কথাও শিবকালীপুরের আবাল-বৃদ্ধবনিতা বিশ্বাস করে। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটিয়া বলিবার সাহস কাহারও নাই।