–হ্যাঁ তোমার কাছে। দিয়েছ ধান তুমি দু বছর? বল?
—আর আমি যে তোমার কাছে হ্যান্ডনেটে টাকা পাব। তাতে কটাকা উসুল দিয়েছ শুনি? ধান দিই নাই…মজলিসের মধ্যে তুমি যে এত বড় কথাটা বলছ!
–কিন্তু তার তো একটা হিসেব নিকেশ আছে? ধানের দামটা তোমার হ্যান্ডনেটের পিঠে উসুল দিতে তো হবে না কি? বলুন চৌধুরী মশায়, মণ্ডল মশাইরাও তো রয়েছেন, বলুন না।
চৌধুরী বলিল—শোন, চুপ কর একটু। শ্ৰীহরি, তুমি বাবা হ্যান্ডনোটের পিঠে টাকাটা উসুল দিয়ে নিয়ো। আর অনিরুদ্ধ, তোমরা একটা বাকির ফর্দ তুলে হরিশ মণ্ডল মশায়কে দাও। এ নিয়ে মজলিসে গোল করাটা তো ভাল নয়। এঁরাই সব আদায়-পত্র করে দেবেন। আর তোমরাও
গাঁয়ে একটা করে পাট রাখ। যেমন কাজকর্ম করছিলে তেমনি কর।
মজলিসসুদ্ধ সকলেই এ কথায় সায় দিল। কিন্তু অনিরুদ্ধ এবং গিরিশ চুপ করিয়া রহিল, ভাবে-ভঙ্গিতেও সম্মতি বা অসম্মতি কোনো লক্ষণ প্রকাশ করিল না।
এতক্ষণে দেবনাথ মুখ খুলিল; প্রবীণ চৌধুরীর এ মীমাংসা তাহার ভাল লাগিয়াছে। অনিরুদ্ধ-গিরিশের পাওনা অনাদায়ের কথা সে জানিত বলিয়াই তাহার প্রথমে মনে হইয়াছিল–অনিরুদ্ধ এবং গিরিশের উপর মজলিস অবিচার করিতে বসিয়াছে। নতুবা গ্রামের সমাজ-শৃঙ্খলা বজায় রাখিবারই সে পক্ষপাতী; তাহার নিজের একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার ধারণা আছে। সেই ধারণা অনুযায়ী আজ দেবু খুশি হইল; অনিরুদ্ধ ও গিরিশের এবার নত হওয়া উচিত বলিয়া তাহার মনে হইল। সে বলিল—অনি ভাই, আর তো তোমাদের আপত্তি করা উচিত নয়।
চৌধুরী প্ৰশ্ন করিল-অনিরুদ্ধ?
—আজ্ঞে।
–কি বলছ বল।
এবার হাত জোড় করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে, আমাদিগে মাপ করুন আপনারা। আমরা আর এভাবে কাজ চালাতে পারছি না।
মজলিসে এবার অসন্তোষের কলরব উঠিয়া গেল।
–কেন?
–না পিরবার কারণ?
–পারব না বললে হবে কেন?
–চালাকি নাকি?
–গাঁয়ে বাস কর না তুমি?
ইহার মধে চৌধুরী নিজের দীর্ঘ হাতখানি তুলিয়া ইঙ্গিত প্রকাশ করিল–চুপ কর, থাম। হরিশ বিরক্তিভরে বলিল—থাম্রে বাপু ছোঁড়ারা; আমরা এখনও মরি নাই।
হরেন্দ্র ঘোষাল অল্পবয়সী ছোকরা এবং ম্যাট্রিক পাস এবং ব্রাহ্মণ। সেই অধিকারে সে প্রচণ্ড একটা চিৎকার করিয়া উঠিল—এইও! সাইলেন্স-সাইলেন্স!
অবশেষে দ্বারকা চৌধুরী উঠিয়া দাঁড়াইল। এবার ফল হইল। চৌধুরী বলিল চিৎকার করে গোলমাল বাধিয়ে তো ফল হবে না! বেশ তো, কর্মকার কেন পারবে না-বলুক। বলতে দাও ওকে।
সকলে এবার নীরব হইল। চৌধুরী আবার বসিয়া বলিল—কর্মকার, পারবে না বললে তো হবে না বাবা। কেন পারবে না, বল! তোমরা পুরুষানুক্ৰমে করে আসছ। আজ পারব না বললে গ্রামের ব্যবস্থাটা কি হবে?
দেবনাথ বলিল—অন্যায়। অনিরুদ্ধ ও গিরিশের এ মহা অন্যায়।
হরিশ বলিল—তোমার পূর্বপুরুষের বাস হল গিয়ে মহাগ্রামে; এ গ্রামে কামার ছিল না। বলেই তোমার পিতামহকে এনে বাস করানো হয়েছিল। সে তো তুমিও শুনেছ হে বাপু। এখন না বললে চলবে কেন?
অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে, মোড়ল জ্যাঠা, তা হলে শুনুন। চৌধুরী মশায় আপনি বিচার করুন। এ গায়ে আগে কত হাল ছিল ভেবে দেখুন। কত ঘরে হাল উঠে গিয়েছে তাও দেখুন। এই ধরুন গদাই, শ্রীনিবাস, মহেন্দ্র আমি হিসেব করে দেখেছি, আমার চোখের ওপর এগারটি ঘরের হাল উঠে গিয়েছে। জমি গিয়ে ঢুকেছে কঙ্কণার ভদ্রলোকদের ঘরে। কঙ্কণায় কামার আলাদা। আমাদের এগারখানা হালের ধান কমে গিয়েছে। তারপরে ধরুন আমরা চাষের সময় কাজ করতাম লাঙ্গলেরগাড়ির, অন্য সময়ে গায়ের ঘরদের হত। আমরা পেরেক গজাল হাতা খুন্তি গড়ে দিতাম-বঁটি কোদাল কুড়ুল গড়তাম,গাঁয়ের লোকে কিনত। এখন গাঁয়ের লোকে সেসব কিনছেন বাজার থেকে। সস্তা পাচ্ছেন—তাই কিনছেন। আমাদের গিরিশ গাড়ি গড়ত, দরজা তৈরি করত; ঘরের চালকাঠামো করতে গিরিশকেই লোকে ডাকত। এখন অন্য জায়গা থেকে সস্তায় মিস্ত্রি এনে কাজ হচ্ছে। তারপর ধরুনধানের দর পাঁচ সিকে—দেড় টাকা, আর অন্য জিনিসপত্র আক্ৰা। এতে আমাদের এই নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকলে কি করে চলে, বলুন? ঘর-সংসার যখন করছি—তখন ঘরের লোকের মুখে তো দুটো দিতে হবে। তার ওপর ধরুন, আজকালকার হাল-চাল সে রকম নেই
ছিরু এতক্ষণ ধরিয়া মনে মনে ফুলিতেছিল, সে সুযোগ পাইয়া বাধা দিয়া কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিল—তা বটে, আজকাল বার্নিশ-করা জুতো চাই, লম্বা লম্বা জামা চাই, সিগারেট চাই পরিবারের শেমিজ চাই, বডি চাই।
—এই দেখ ছিরু মোড়ল, তুমি একটু হিসেব করে কথা বলবে। অনিরুদ্ধ এবার কঠিন স্বরে প্রতিবাদ করিয়া উঠিল।
ছিরু বারকতক হেলিয়া-দুলিয়া বলিয়া উঠিল, হিসেব আমার করাই আছে রে বাপু। পঁচিশ টাকা ন আনা তিন পয়সা। আসল দশ টাকা, সুদ পনের টাকা ন আনা তিন পয়সা। তুই বরং কষে দেখতে পারিস। শুভঙ্করী জানিস তো?
হিসাবটা অনিরুদ্ধের নিকট পাওনা হ্যান্ডনেটের হিসাব। অনিরুদ্ধ কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল সমস্ত মজলিসের দিকে একবার সে চাহিয়া দেখিল। সমস্ত মজলিসটাও এই আকস্মিক অপ্রত্যাশিত বৃঢ়তায় স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। অনিরুদ্ধ মজলিস হইতে উঠিয়া পড়িল।
ছিরু ধমক দিয়া উঠিল—যাবে কোথা তুমি?
অনিরুদ্ধ গ্রাহ্য করিল না, সে চলিয়া গেল।
চৌধুরী এতক্ষণে বলিল—শ্ৰীহরি!
ছিরু বলিল-আমাকে চোখ রাঙাবেন না চৌধুরী মশায়, দু-তিনবার আপনি আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন, আমি সহ্য করেছি। আর কিন্তু আমি সহ্য করব না।