–ভয় কি? হাঙ্গামাও কিছু হবে বলে তো মনে নেয় না বাবা! নানা—হাঙ্গামা কিছু হবে না–
অপরাত্নে সকলে দল বাঁধিয়া ডাক্তারের কাছে হাজির হইল। আসিল না কেবল পাতু।
ও বেলার ক্রুদ্ধ ডাক্তার এ বেলায় তাহাদের আসিতে দেখিয়া খুশি হইয়া উঠিয়াছিল; বেশ করিয়া সকলকে দেখিয়া লইয়া বলিলপাতু কই, পাতু?
সতীশ বলিলপাতু আজ্ঞে আসবে না। সে মশাই গায়েই থাকবে না বলছে।
–গাঁয়েই থাকবে না? কেন, এত রাগ কেন রে?
—সে মশায় সে-ই জানে। সে আপনার,–উ-পারে জংশনে গিয়ে থাকবে। বলে, যেখনে খাটবে সেখানেই ভাত।
—দেবোত্তরের জমি ভোগ করে যে!
-জমি ছেড়ে দেবে মশায়। বলে ওতে পেট ভরে না, তা উঁকি হবে। উ-সব বড়নোকের কথা ছেড়ে দেন। পাতু বায়েন আমাদের বড়নোক উকিল ব্যালেস্টারের শামিল।
—আহা তাই হোক। সে বড়নোকই হোক। তোমার মুখে ফুলচন্নন পড়ুক। দলের পিছনে ছিল দুর্গা, সে ফোঁস করিয়া উঠিল। তারপর বলিল—সে যদি উঠেই যায় গা থেকে, তাতে নোকের কি শুনি? উকিল ব্যালেস্টার—সাত-সতের বলা ক্যানে শুনি? সে যদি চলেই যায় তাতে তো ভাল হবে তোদেরই। ভিক্ষের ভাগ তোদের মোটা হবে।
জগন ডাক্তার ধমক দিয়া উঠিল—থাম, থাম দুর্গা।
–ক্যানে, থামব ক্যানে? কিসের লেগে? এত কথা কিসের?—বলিয়াই সে মুখ ফিরাইয়া আপনার পাড়ার দিকে পথ ধরিল।
–ওই! এই দুৰ্গা, টিপ-সই দিয়ে যা!
–না-–।
–তা হলে কিন্তু সরকারি টাকার কিছুই পাবি না তুই।
এবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া মুখ মুচকাইয়া দুর্গা বলিল-আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো। তোমার তালগাছ বিক্রি আছে শুনে এসেছিলাম কিনতে। গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি! সে আবার মুহূর্তে ঘুরিয়া আপনার মনেই পথ চলিতে আরম্ভ করিল।
পথে বাঁশ-জঙ্গলে ঘেরা পাল-পুকুরের কোণে আসিয়া দুৰ্গা দেখিল বাঁশবনের আড়ালে শ্ৰীহরি পাল দাঁড়াইয়া আছে। দুর্গা হাসিয়া দুই হাত জড়ো করিয়া একটা পরিমাণ ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলিলটাকা চাই! এই এতগুলি! ঘর করব। বুঝেছ?
শ্ৰীহরি কথাটা গ্রাহ্য করিল না, প্ৰশ্ন করিলকিসের দরখাস্ত হচ্ছে রে?
—ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে। ঘর পুড়ে গিয়েছে—তাই।
শ্ৰীহরি শুনিবামাত্র অকারণে চমকিয়া উঠিল, পরক্ষণেই মুখখানা ভয়ঙ্কর করিয়া তুলিয়া চাপা গলায় বলিল,—তাই আমাকে সুবে করে দরখাস্ত করছে বুঝি শালা ডাক্তার? শালাকে–
দুর্গার বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে শ্ৰীহরিকে চেনে। ছিরু পাল ছোট খোকার মত দেয়ালা করিয়া অকারণে চমকিয়া ওঠে না। স্থির তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতেই অপরাধীকে চিনিয়া ফেলিল এবং বলিল,া গো, তুমিই যে দিয়েছ আগুন!
শ্ৰীহরি হাসিয়া বলিল, কে বললে দিয়েছি! তুই দেখেছিস? সে আর কথাটা দুর্গার কাছে গোপন করিতে চাহিল না।
দুর্গা বলিল,—ঠাকুর ঘরে কে রে? না, আমি তো কলা খাই নাই। সেই বৃত্তান্ত। হ্যাঁ দেখেছি বৈকি আমি।
—চুপ কর, এতগুলো টাকাই দোব আমি।
দুৰ্গা আর উত্তর করিল না। ঠোঁট বাঁকাইয়া বিচিত্র দৃষ্টিতে শ্ৰীহরির দিকে মুহূর্তের জন্য চাহিয়া দেখিয়া আপন পথে চলিয়া গেল। দন্তহীন মুখে হাসিয়া ছিরু তাহার গমনপথের দিকে চাহিয়া রহিল।
০৮. দুৰ্গা বেশ সুশ্রী সুগঠন মেয়ে
দুৰ্গা বেশ সুশ্রী সুগঠন মেয়ে। তাহার দেহবর্ণ পর্যন্ত গৌর, যাহা তাহাদের স্বজাতির পক্ষে যেমন দুর্লভ তেমনি আকস্মিক। ইহার উপর দুর্গার রূপের মধ্যেও এমন একটা বিস্ময়কর মাদকতা আছে, যাহা সাধারণ মানুষের মনকে মুগ্ধ করে মত্ত করে—দুর্নিবারভাবে কাছে টানে।
পাতু নিজেই দ্বারকা চৌধুরীকে বলিয়াছিল—আমার মা-হারামজাদীকে তো জানেন? হারামজাদীর স্বভাব আর গেল না!
দুর্গার রূপের আকস্মিকতা পাতুর মায়ের সেই স্বভাবের জীবন্ত প্ৰমাণ।
এই স্বভাব দমনের জন্য কোনো কঠোর শাস্তি বা পরিবর্তনের জন্য কোনো আদর্শের সংস্কার ইহাদের সমাজে নাই। অল্পস্বল্প উচ্ছঙ্খলতা, স্বামীরা পর্যন্ত দেখিয়াও দেখে না। বিশেষ করিয়া উচ্ছলতার সহিত যদি উচ্চবর্ণের সচ্ছল অবস্থার পুরুষ জড়িত থাকে তাহা হইলে তো তাহারা বোব হইয়া যায়। কিন্তু দুর্গার উচ্ছঙ্খলতা সে-সীমাকেও অতিক্ৰম করিয়া গিয়াছে! সে দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী; ঊর্ধ্ব বা অধঃলোকের কোনো সীমাকেই অতিক্ৰম করিতে তাহার দ্বিধা নাই। নিশীথ রাত্রে সে কঙ্কণার জমিদারের প্রমোদভবনে যায়, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে সে জানে; লোকে বলে দারোগা, হাকিম পর্যন্ত তাহার অপরিচিত নয়। সেদিন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান মুখার্জী সাহেবের সহিত সে গভীর রাত্রে পরিচয় করিয়া আসিয়াছে, দফাদার শরীররক্ষীর মত সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিল। দুর্গা ইহাতে অহঙ্কার বোধ করে, নিজেকে স্বজাতীয়দের অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ মনে করে; নিজের কলঙ্ক সে গোপন করে না। এ স্বভাবের জন্য লোকে দায়ী করে তাহার মা নাকি কন্যাকে স্বামী পরিত্যাগ করাইয়া এই পথ দেখাইয়া দিয়াছে! কিন্তু দায়ী তাহার মা নয়। তাহার বিবাহ হইয়াছিল কঙ্কণায়। দুর্গার শাশুড়ি কঙ্কণার এক বাবুর বাড়িতে ঝাড়ুদারণীর কাজ করিত। একদিন শাশুড়ির অসুখ করিয়াছিল—দুর্গা গিয়াছিল শাশুড়ির কাজে। বাবুর বাড়ির চাকরটা সকল কাজের শেষে তাহাকে ধমক দিয়া বাবুর বাগানবাড়ি ঝট দিবার জন্য একটা নির্জন ঘরে ঢুকাইয়া দিয়াছিল। ঘরটা কিন্তু নির্জন ছিল না। জনের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং গৃহস্বামী বাবু। সন্ত্রস্ত হইয়া দুৰ্গা ঘোমটা টানিয়া দরজার দিকে ফিরিল, কিন্তু এ কি? এ যে বাহির হইতে দরজা কে বন্ধ করিয়া দিয়াছে!