অনিরুদ্ধ এবং গিরিশ আসিয়া মজলিসে বসিল। বেশভূষা অনেকটা পরিচ্ছন্ন এবং ফিটফাট তাহার মধ্যে শহুরে ফ্যাশনের ছাপ সুস্পষ্ট; দুজনেই সিগারেট টানিতে টানিতে আসিতেছিল—মজলিসের অনতিদূরেই ফেলিয়া দিয়া মজলিসের মধ্যে আসিয়া বসিল।
অনিরুদ্ধ কথা আরম্ভ করিল; বসিয়াই হাত দিয়া একবার মুখটা বেশ করিয়া মুছিয়া লইয়া বলিল—কই গো, কি বলছেন বলুন। আমরা খাঁটি-খুটি খাই; আমাদের আজ এ বেলাটাই মাটি।
কথার ভঙ্গিমায় ও সুরে সকলেই একটু চকিত হইয়া উঠিল, যেন ঝগড়া করিবার মতলবেই। কোমর বাঁধিয়া আসিয়াছে : প্রবীণের দলের মধ্যে সকলেই একবার সশব্দে গলা ঝাড়িয়া লইল। অল্পবয়সীদের ভিতর হইতে যেন একটা আগুন দপ করিয়া উঠিল; ছিরু ওরফে শ্রীহরি বলিয়া উঠিল—মাটিই যদি মনে কর, তবে আবারই বা কি দরকার ছিল?
হরেন্দ্র ঘোষাল কথা বলিবার জন্য হাঁকপাক করিতেছিল; সে বলিল—তেমন মনে হলে এখনও উঠে যেতে পারতোমরা। কেউ ধরে নিয়েও আসে নাই, বেঁধেও রাখে নাই তোমাদিগে।
হরিশ মণ্ডল এবার বলিল—চুপ কর তোমরা। এখানে যখন ডাকা হয়েছে, তখন আসতেই হবে। তা তোমরা এসেছ, বেশ কথা-ভাল কথা, উত্তম কথা। তারপর এখন দুপক্ষে কথাবার্তা হবে, আমাদের বলবার যা বলব—তোমাদের জবাব যা তোমরা দেবে; তারপর তার বিচার হবে। এত তাড়াতাড়ি করলে হবে কেন? ঘোড়া দুটো বাধো।
গিরিশ বলিল—তা হলে, কথা আপনাদের আমাদিগে নিয়েই?
অনিরুদ্ধ বলিলতা আমরা অ্যাঁচ করেছিলাম। তা বেশ, কি কথা আপনাদের বলুন? আমাদের জবাব আমরা দোব। কিন্তু কথা হচ্ছে কি জানেন আপনারা সবাই যখন একজোট হয়েছেন, তখন এ-কথার বিচার করবে কে? নালিশ যখন আপনাদের, তখন আপনারা বিচার কি করে করবেন—এ তো আমরা বুঝতে পারছি না।
দ্বারকা চৌধুরী অকস্মাৎ গলা ঝাড়িয়া শব্দ করিয়া উঠিল; চৌধুরীর কথা বলিবার এটি পূর্বাভাস। উচ্চ গলা-ঝাড়ার শব্দে সকলে চৌধুরীর দিকে ফিরিয়া চাহিল। চৌধুরীর চেহারায় এবং ভঙ্গিমাতে একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। গৌরবর্ণ রং সাদা ধবধবে গোঁফ, আকৃতিতে দীর্ঘ। মানুষটি আসরের মধ্যে আপনাআপনি বিশিষ্ট হইয়া বসিয়াছিল। সে এবার মুখ খুলিল—দেখ কর্মকার, কিছু মনে কোরো না বাপু, আমি একটা কথা বলব। গোড়া থেকেই তোমাদের কথাবার্তার সুর শুনে মনে হচ্ছে যেন তোমরা বিবাদ করবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছ! এটা তো ভাল নয় বাবা। বস, স্থির হয়ে বস।
অনিরুদ্ধ এবার সবিনয়ে ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল—বেশ, বলুন কি বলছেন।
হরিশ মণ্ডলই আরম্ভ করিল—দেখ বাপু, খুলে বলতে গেলে মহাভারত বলতে হয়। সংক্ষেপেই বলছি—তোমরা দুজনে শহরে গিয়ে আপিন আপন ব্যবসা করতে বসেছ। বেশ করেছ। যেখানে মানুষ দুটো পয়সা পাবে সেখানেই যাবে। তা যাও। কিন্তু এখানকার পাঠ যে একেবারে তুলে দেবে, আর আমরা যে এই দু কোশ রাস্তা জিনিসপত্র ঘাড়ে করে নিয়ে ছুটব ওই নদী পার হয়ে, তা তো হবে না বাপু। এবার যে তোমরা আমাদের কি নাকাল করেছ সে কথাটা ভেবে দেখ দেখি মনে মনে।
অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে, তা অসুবিধে একটুকুন হয়েছে আপনাদের।
চিরু বা শ্রীহরি গর্জিয়া উঠিল—একটুকুন! একটুকুন কি হে? জান, জমিতে জল থাকতে ফাল পাজানোর অভাবে চাষ বন্ধ রাখতে হয়েছে? তোমারও তত জমি আছে, জমির মাথায়। একবার ঘুরে দেখে এস দেখি পটুপটি ঘাসের ধূমটা। ভাল ফালের অভাবে চাষের সময় একটা পটপটিরও শেকড় ভাল ওঠে নাই। বছর সাল তোমরা ধানের সময় ধানের জন্যে বস্তা হাতে করে এসে দাঁড়াবে, আর কাজের সময় তখন শহরে গিয়ে বসে থাকবে, তা করতে হবে কেন?
হরেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়া উঠিল—এই কথা! এবং সঙ্গে সঙ্গে হাতে একটা তালি বাজাইয়া দিয়া বসিল।
মজলিসসুদ্ধ সকলেই প্রায় সমস্বরে বলিল—এই।
প্রবীণরাও ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। অর্থাৎ এই।
অনিরুদ্ধ এবার খুব সপ্রতিভ ভঙ্গিতে নড়িয়াচড়িয়া অ্যাঁকিয়া বসিয়া বলিল—এই তো আপনাদের কথা? আচ্ছা, এইবার আমাদের জবাব শুনুন। আপনাদের ফাল পজিয়ে দিই, হাল লাগিয়ে দিই চাকায়, কাস্তে গড়ে দিই, আপনারা আমাকে ধান দেন হালপিছু কচি পাঁচ শলি। আমাদের গিরিশ সূত্রধর–
বাধা দিয়া ছিরু পাল বলিল—গিরিশের কথায় তোমার কাজ কি হে বাপু?
কিন্তু ছিরু কথা শেষ করিতে পারিল না; দ্বারকা চৌধুরী বলিল-বাবা শ্রীহরি, অনিরুদ্ধ তো অন্যায় কিছু বলে নাই। ওদের দুজনের একই কথা। একজন বললেও তো ক্ষতি নাই কিছু।
ছিরু চুপ করিয়া গেল। অনিরুদ্ধ ভরসা পাইয়া বলিল চৌধুরী মশায় না থাকলে কি মজলিসের শোভা হয়,উচিত কথা বলে কে?
—বল অনিরুদ্ধ কি বলছিলে, বল!
–আজ্ঞে, হ্যাঁ। আমার, মানে কর্মকারের হালপিছু পাঁচ শলি, আর সূত্রধরের হালপিছু চার শলি করে ধান বরাদ্দ আছে। আমরা এতদিন কাজ করে আসছি, কিন্তু চৌধুরী মশাই, ধান আমরা ঠিক হিসেবমত প্রায়ই পাই না।
–পাও না?
–আজ্ঞে না।
গিরিশ সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল—আজ্ঞে না। প্রায় ঘরেই দু-চার আড়ি করে বাকি রাখে, বলে, দু-দিন পরে দোব, কি আসছে বছর দোব। তারপর সে ধান আমরা পাই না।
ছিরু সাপের মত গৰ্জিয়া উঠিল—পাও না? কে দেয় নি শুনি? মুখে পাই না বললে তো হবে না। বল, কার কাছে পাবে তোমরা?
অনিরুদ্ধ দুরন্ত ক্ৰোধে বিদ্যুৎগতিতে ঘাড় ফিরাইয়া শ্ৰীহরির দিকে চাহিয়া বলিল—কার কাছে পাব? নাম করতে হবে? বেশ, বলছি।তোমার কাছেই পাব।
—আমার কাছে?