পাতু এবার শঙ্কিত হইয়া ঝুঁকিয়া বউয়ের মুখের দিকে চাহিয়া অকস্মাৎ এক মুহূর্তে হাউ। হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল—ওগো, আমি বউকে মেরে ফেললাম গো।
পাতুর মা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল—ওরে বাবা, কি করলি রে?
ডাক্তার ব্যস্ত হইয়া বলিল—এরে জল, শিগগির জল আন।
দুর্গা ছুটিয়া জল লইয়া আসিল। সে বউয়ের মাথাটা কোলে তুলিয়া লইয়া বসিয়া বুকে হাত বুলাইতে আরম্ভ করিল, ডাক্তার ছপাছপ জলের ছিটা দিয়া বলিল—কই, মুখে মুখ দিয়ে ফুঁ দে দেখি দুগ্গা।
কিন্তু ফুঁ আর দিতে হইল না, বউ আপনিই একটা দীর্ঘ বিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল। কিছুক্ষণ পরে সে উঠিয়া বসিয়া কাঁদিতে আরম্ভ কলিল—আমাকে আর কারুর মেমতা করতে হবে না রে, সংসারে আমার কেউ লাই রে। গলা তাহার ধরিয়া গিয়াছে, আওয়াজ বাহির হয় না; তবু সে প্রাণপণে চিৎকার আরম্ভ করিল।
****
জগন ডাক্তার কতগুলি ঘর পুড়িয়াছে গণনা করিয়া নোটবুকে লিখিয়া লইল; কতগুলি মানুষ বিপন্ন তাহাও লিখিয়া লইল। খবরের কাগজে পাঠাইতে হইবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে একটা আবেদনের খসড়া সে ইতিপূর্বেই করিয়া ফেলিয়াছে। স্থানীয় চার-পাঁচখানা গ্রামের অধিবাসীদের নিকট হইতে ভিক্ষা করিয়া খড়, বাঁশ, চাল, পুরনো কাপড়, অর্থ সংগ্রহের জন্য একটা সাহায্য-সমিতি গঠনের কল্পনাও মনে মনে ছকিয়া ফেলিয়াছে।
এ পাড়ার সকলকে ডাকিয়া ডাক্তার বলিল—সর আপন আপন মনিবের কাছে যা, গিয়ে বল-দুটো করে বাঁশ, দশ গণ্ডা করে খড়, পাঁচ-সাত দিনের মত খোরাকি আমাদের দিতে হবে। আর যা লাগবে—চেয়ে-চিন্তে আমি যোগাড় করছি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে একটা দরখাস্ত দিতে হবে আমি লিখে রাখছি, ও বেলায় গিয়ে সব টিপসই দিয়ে আসবি।
সকলে চুপ করিয়া রহিল, ম্যাজিস্ট্রেটের নামে তাহারা ভড়কাইয়া গিয়াছে। সাহেব-সুবাকে ইহারা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলিয়াই জানে, কনস্টেবল দাবোগার উপরওয়ালা হিসাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নামে তাহাদের আতঙ্ক বহুগুণ বাড়িয়া যায়। তাহার কাছে দরখাস্ত পাঠাইয়া আবার কোন ফ্যাসাদ বাধিবে কে জানে!
জগন বলিলবুঝলি আমার কথা? চুপ করে রইলি যে সব!
এবার সতীশ বাউরি বলিল—আজ্ঞে সায়েবের কাছে—
–হ্যাঁ, সায়েবের কাছে।
–শেষে, আবার কি-না-কি ফ্যাসাদ হবে মশায়!
ফ্যাসাদ কিসের রে? জেলার কর্তা, প্রজার সুখ-দুঃখের ভার তার ওপর। দুঃখের কথা জানালেই তাঁকে সাহায্য করতে হবে।
–আজ্ঞে, উ মশায়—
–উ আবার কি?
–আজ্ঞে, কনস্টেবল-দারোগা-থানা-পুলিশ–টানা-হ্যাঁচড়া-কৈফেত—সে মশায় হাজার হাঙ্গামা!
ডাক্তার এবার ভীষণ চটিয়া গেল। তাহার কথায় প্রতিবাদ করিলে সে চটিয়াই যায়! তাহার উপর এই লোক-হিতৈষণা উপলক্ষ করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত পরিচিত হওয়ার একটা প্রবল বাসনা তাহার ছিল। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সভ্যশ্রেণীভুক্ত হইবার আকাঙ্ক্ষা তাহার অনেক দিনের; কেবলমাত্র মান-মর্যাদা লাভের জন্যই নয়, দেশের কাজ করিবার আকাঙ্ক্ষাও তাহার আছে। কিন্তু কঙ্কণার বাবুরাই ইউনিয়ন বোর্ডের সমস্ত সভ্যপদগুলি দখল করিয়া রহিয়াছে। ইউনিয়নের সমস্ত গ্রামগুলিই কঙ্কণার বিভিন্ন বাবুদের জমিদারি। গতবার জগন ঘোষ বোর্ডের ইলেকশনে নামিয়া মাত্র তিনটি ভোট পাইয়াছিল। সরকার তরফ হইতে মনোনীত সভ্যপদগুলিও কঙ্কণার বাবুদের একচেটিয়া। সাহেব-সুবোরা উহাদিগকেই চেনে, কঙ্কণাতেই তাহারা আসে যায়, সভ্য মনোনয়নের সময়ও এই দরখাস্তগুলিই মঞ্জুর হইয়া যায়। এই কারণে এমন একটি পরহিতব্রতের ছুতা লইয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সহিত দেখা করিবার সঙ্কল্পটি ডাক্তারের বহু আকাঙ্ক্ষিত এবং পরম কাম্য। সেই সঙ্কল্প পূরণের পথে বাধা পাইয়া ডাক্তার ভীষণ চটিয়া উঠিল। বলিল—তবে মর গে তোরা, পচে মৰ্ব গে। হারামজাদা মুখর দল সব।
—কি, হল কি ডাক্তার—বলিয়া ঠিক এই মুহূর্তটিতেই বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী পিছনের গাছপালার আড়াল অতিক্ৰম করিয়া সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী ইহাদের এই আকস্মিক বিপদে সহানুভূতি প্ৰকাশ করিতে আসিয়াছেন। এ তাহাদের পূর্বপুরুষের প্রবর্তিত কর্তব্য! সে কৰ্তব্য আজও তিনি যথাসাধ্য পালন করেন। ব্যবস্থাটার মধ্যে দয়ারই প্রাধান্য, কিন্তু প্রেমও খানিকটা আছে।
ডাক্তার চৌধুরীকে দেখিয়া বলিল—দেখুন না, বেটাদের মুখুমি। বলছি, ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে একটা দরখাস্ত কর। তা, বলছে কি জানেন? বলছে, থানা-পুলিশ-দারোগাসায়েব-সুবো-বেজায় হাঙ্গামা।
চৌধুরী বলিল, তা মিছে বলে নাই—এর জন্যে আর সায়েব-সুবো কেন ভাই? গাঁয়ের পাঁচজনের কাছ থেকেই তো ওদের কাজ হয়ে যাবে! ধর, আমি ওদের প্রত্যেককে দুগণ্ডা করে খড় দেব, পাঁচটা বাঁশ দোব; এমনি করে—
ডাক্তার আর শুনিল না, হনহন করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল। যাইবার সময় সে বলিয়া গেলযাস বেটারা এর পর আমার কাছে। আরও কিছুদূর আসিয়া আবার দাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া বলিল-কাল রাত্রে কে কোথায় ছিল রে? কাল রাত্রে? চৌধুরীর কথায় সে বেজায় চটিয়া গিয়াছে।
চৌধুরী একটু চিন্তা করিয়া বলিলতা দরখাস্ত করতেই বা দোষ কি বাবা সতীশ? ডাক্তার যখন বলছে। আর সায়েবের যদি দয়াই হয়—সে তো তোমাদেরই মঙ্গল! তাই বরং তোমরা। যেও ডাক্তারের কাছে।
সতীশ বলিল হাঙ্গামা কিছু হবে না তো চৌধুরী মশায়? আমাদের সেই ভয়টাই বেশি নাগছে কিনা।