পাতুর কিন্তু এসব ভরসা নাই। সে জাতিতে বায়েন বা বাদ্যকর অর্থাৎ মুচি। তাহার কিছু চাকরান জমি আছে। গ্রামের সরকারি শিবতলা, কালীতলা এবং পাশের গ্রামে চণ্ডীতলায় নিত্য ঢাক বাজায়। সেইহেতু বৎসরে দেবোত্তর সম্পত্তির কিছু ধান সে পিতামহদের আমল হইতে পাইয়া আসিতেছে। নিজের দুইটা হেলে বলদ আছে—তাই দিয়া সে নিজের জমির সঙ্গে ওই কঙ্কণার ভদ্রলোকের কিছু জমিও ভাগে চাষ করিয়া থাকে। এ ছাড়া ভাগাড়ের মরা গরু-মহিষের চামড়া ছাড়াইয়া পূর্বে সে চামড়া ব্যবসায়ী শেখদের বিক্রয় করিত। আপদে-বিপদে তাহারাই দু-চারি টাকা দাদনস্বরূপ দিত। কিন্তু সম্প্ৰতি জমিদার ভাগাড় বন্দোবস্ত করায় এদিকের আয় তাহার অনেক কমিয়া গিয়াছে। নেহাত পারিশ্রমিক অর্থাৎ তিন-চার আনা মজুরি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। ইহা লইয়া চামড়াওয়ালার সঙ্গে মনান্তরও হইয়াছে। সে কি আর এ সময় সাহায্য করবে? যে ভদ্রলোকের জমি ভাগে চাষ করে, সে কিছু দিলেও দিতে পারে; কিন্তু ভদ্রলোক খৎ না লেখাইয়া কিছু দিবে না। সেও অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার। খৎকে পাতুর বড় ভয়। শেষ পর্যন্ত নালিশ করিয়া বাড়িটা লইয়া বসিলে সে যাইবে কোথায়? পৃথিবীর মধ্যে তাহার। সম্পত্তি এই বাড়িটুকু।
আপন মনে ভাবিতে ভাবিতে পাতু দ্রুতগতিতে ছাই জড়ো করিয়া চলিয়াছিল। ছিরু পালের কাছে সেদিন মার খাইয়া তাহার মনে যে উত্তেজনা জাগিয়া উঠিয়াছিল—সে উত্তেজনা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। সে উত্তেজনাবশেই সেদিন অমরকুণ্ডার মাঠে দ্বারকা চৌধুরীর কাছে ছিরু পাল সম্পর্কে আপনার সহোদরা দুর্গার যে কলঙ্কের কথা প্রকাশ করিয়া নালিশ করিয়াছিল তাই লইয়াই গত সন্ধ্যায় স্বজাতির মধ্যে তাহার যথেষ্ট লাঞ্ছনা হইয়াছে। স্বজাতিরা কথাটা লইয়া ঘোট পাকাইয়া তাহাকে প্ৰশ্ন করিয়াছিল—তুমি তো আপন মুখেই এই কেলেঙ্কারির কথা চৌধুরী মহাশয়ের কাছে বলেছ, জমিদারের কাছারিতে বলেছ। বলেছ কি না?
–হ্যাঁ, বলেছি।
–তবে? তুমি পতিত হবে না কেন, তা বল?
কথাটা পাতুর ইহার পূর্বে ঠিক খেয়াল হয় নাই। সে চমকিয়া উঠিয়াছিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে হনহন করিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়া দুর্গার চুলের মুঠি ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া তাহাকে মজলিসের সম্মুখে হাজির করিয়াছিল। ধাক্কা দিয়া দুর্গাকে মাটির উপরে ফেলিয়া দিয়া বলিয়াছিল—সে কথা এই হারামজাদী ছেনাকে শুধাও! ভিনু ভাতে বাপ পড়শী; আমি ওর সঙ্গে পেথকান্ন!
দুর্গার পেছনে পেছনে তাহার মা চিৎকার করিতে করিতে আসিয়াছিল; সকলের পেছনে পাতুর বিড়ালীর মত বউটাও গুনগুন করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়াছিল। তারপর সে এক চরম অশ্লীল বাক-বিতণ্ডা। স্বৈরিণী দুর্গা উচ্চকণ্ঠে পাড়ার প্রত্যেকটি মেয়ের কুকীর্তির গুপ্ত ইতিহাস প্রকাশ করিয়া পাতুর মুখের ওপর সদম্ভে ঘোষণা করিয়া বলিয়াছিল-ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশি যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে। তোর কি? তাতে তোর কি? তু আমাকে খেতে দিস, না, দিবি? আপন পরিবারকে সামলাস তু।
পাতু আরও ঘা-কতক লাগাইয়া দিয়াছিল। পাতুর বউটি ঘোমটার ভিতর হইতে তীক্ষকণ্ঠে ননদকে গাল দিতে শুরু করিয়াছিল। মজলিসের উত্তাপের মধ্যে উত্তেজিত কলরব হাতাহাতির সীমানায় বোধ করি গিয়া পৌঁছিয়াছিল—ঠিক এই সময়েই আগুন জ্বলিয়া ওঠে।
এই দুই দিনের উত্তেজনা, তাহার উপর এই অগ্নিদাহের ফলে গৃহহীনতার অপরিমেয় দুঃখ তাহাকে রুদ্ধমুখ আগ্নেয়গিরির মত করিয়া তুলিয়াছিল। সে নীরবেই কাজ করিয়া চলিতেছিল, এমন সময় তার বউয়ের ছিচকান্না তাহার কানে গেল। সে এতক্ষণে ছাগল-গরুগুলিকে অদূরবর্তী খেজুরগাছগুলার গোড়ায় খেটা পুঁতিয়া দিল। তাহার পর হাঁসগুলিকে নিকটবর্তী পুকুরের জলে নামাইয়া দিয়া, স্বামীর কাজে সাহায্য করতে আসিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই গুনগুনানির কান্নার রেশও টানিয়া চলিল। পাতু হিংস্ৰ জানোয়ারের মত পাঁত বাহির করিয়া গৰ্জন করিয়া। উঠিল—এ্যাঁই দেখ, মিহি গলায় আর ঢং করে কাঁদিস না বলছি। মেরে হাড় ভেঙে দোব–হ্যাঁ।
ঘর পুড়িয়া যাওয়ার দুঃখে এবং সমস্ত রাত্রি কষ্টভোগের ফলে পাতুর বউয়ের মেজাজও খুব ভাল ছিল না, সে বন্যবিড়ালীর মত হিংস্র ভঙ্গিতে ফাঁস করিয়া উঠিল—ক্যানে, ক্যানে আমার হাড় ভেঙে দিবি শুনি? বলে দরবারে হেরে, মাগকে মারে ধরে—সেই বিত্তান্ত। নিজের ছেনাল বোনকে কিছু বলবার ক্ষোমতা নাই
পাতুর আর সহ্য হইল না, সে বাঘের মত লাফ দিয়া বউকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার বুকে বসিয়া গলা টিপিয়া ধরিল। তাহার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান তখন লোপ পাইয়া গিয়াছে।
পাতুর ঘরের সম্মুখেই একই উঠানের ওপাশে দুর্গা ও তাহার মায়ের ঘর। তাহারাও ঘরের ছাই পরিষ্কার করিতেছিল। বউয়ের কথা শুনিয়া দুৰ্গা দংশনোদ্যত সাপিনীর মতই ঘুরিয়া দাঁড়াইয়াছিল; পাতুর নির্যাতন ব্যবস্থা দেখিয়া বিজ্ঞভাবে ভাইকেই বলিলা বউকে একটুকুন শাসন কর, মাথায় তুলিস না।
সেই মুহূর্তেই জগন ডাক্তারের ধরা-গলা শোনা গেল, সে হা হা করিয়া বলিল ছাড় ছাড় হারামজাদা বায়েন, মরে যাবে যে!
কথা বলিতে বলিতে ডাক্তার আসিয়া পাতুর চুলের মুঠি ধরিয়া আকৰ্ষণ করিল। পাতু বউকে ছাড়িয়া দিয়া হাঁপাইতে পাইতে বলিল দেখেন দেখি হারামজাদীর আস্পা, ঘরে আগুনটাগুন লাগিয়ে–
–জল আন্, জল। জলদি, হারামজাদা গোয়ার-বলিয়া জগন হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িল। বউটা অচেতন হইয়া অসাড়ের মত পড়িয়া আছে। ডাক্তার ব্যস্ত হইয়া নাড়ি ধরিল।