ওদিকে কিন্তু ঝগড়াটা ক্রমশই প্রবলতর হইয়া উঠিতেছে। শ্ৰীহরি আবার একটা বিড়ি ধরাইল। কিছুক্ষণ পরে সে গাছতলা হইতে বাহির হইয়া জ্বলন্ত বিড়িটা পাতুর চালের মধ্যে
জিয়া দিয়া দ্রুত লঘুপদে আপন বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।
ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপেও ভদ্ৰ সজ্জনদের প্রবল আলোচনা চলিতেছে।
শ্ৰীহরি হাসিল।
কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের ঊর্ধ্বলোকে অন্ধকার আকাশ রক্তাভ আলোয় ভয়াল হইয়া উঠিল। আকাশের নক্ষত্ৰ মিলাইয়া গিয়াছে। উৎক্ষিপ্ত খড়ের জ্বলন্ত অঙ্গার আকাশে উঠিয়া ফুলঝুরির মত নিবিয়া যাইতেছে। মাঝে মাঝে হাউই-এর মত প্ৰজ্বলিত বাখারিগুলি সশব্দে বাগানের মাথায় ঠিকরাইয়া পড়িতে লাগিল। আগুন! আগুন! ভয়ার্ত চিৎকার—শিশু ও নারীর উচ্চ কান্নার রোলে
শূন্যলোকর বায়ুতরঙ্গ মুখর, ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।
নিমেষে বকুলতার জটলা এবং তাহার পরই চণ্ডীমণ্ডপের মজলিস ভাঙিয়া গেল।
০৭. পাতুর ঘরের আগুন
একা পাতুর ঘর নয়, পাতুর ঘরের আগুন ক্রমশ বিস্তৃত হইয়া সমস্ত হরিজন-পল্লীটাকেই পোড়াইয়া দিল। বড় বড় গাছের আড়াল পাইয়া খান-দুই-তিন ঘর কোনো রকমে বাঁচিয়াছে। বাকি ঘরগুলি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পুড়িয়া গিয়াছে। সামান্য কুটিরের মত নিচু-নিচু ছোট ছোট ঘর-বশের হালকা কাঠামোর উপর অল্প খড়ের পাতলা ছাউনি; কার্তিকের প্রথম হইতে বৃষ্টি না হওয়ায় রোদে শুকাইয়া বারুদের মত দাহ্যবস্তু হইয়াই ছিল; আগুন তাহাতে স্পর্শ করিবামা বিস্ফোরণের মতই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়া গেল। গ্রামের লোক অনেকেই ছুটিয়া। আসিয়াছিল—বিশেষ করিয়া অল্পবয়সী ছেলের দল। তাহারা চেষ্টাও অনেক করিয়াছিল, কিন্তু জল তুলিবার পাত্রের অভাব এবং বহ্নিমান সঙ্কীর্ণ চালাগুলিতে দাঁড়াইবার স্থানের অভাবে তাহারা কিছু করিতে পারে নাই। তাহাদের মুখপাত্র ছিল জগন ডাক্তার। অগ্নিদাহের সমস্ত সময়টা চিৎকার করিয়া সেনাপতির মত আদেশ দিয়া ও উপদেশ বাতলাইয়া এমন গলা ফাটাইয়া ফেলিল যে, আগুন নিবিতে নিবিতে তাহার গলার আওয়াজও বসিয়া গেল।
রাত্রে উহাদের সকলকে চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া শুইতে অনুমতি দেওয়া হইল; কিন্তু আশ্চর্য মানুষ উহারা—কিছুতেই ওই পোড়া ভিটার মায়া ছাড়িয়া আসিল না। সমস্ত রাত্রি পোড়া ঘরের আশপাশে কোনোরূপে স্থান করিয়া লইয়া হেমন্তের এই শীতজর্জর রাত্রিা কাটাইয়া দিল। ছেলেগুলা অবশ্য ঘুমাইল; মেয়েগুলা গানের মত সুর করিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া দিল, আর পুরুষেরা পরস্পরকে দোষ দিয়া নিজের কৃতিত্বের আস্ফালন করিল এবং দগ্ধগৃহের আগুন তুলিয়া ক্রমাগত তামাক খাইল।
প্রায় ঘরেই দু-একটা গুরু, দুই-চারিটা ছাগল আছে; আগুনের সময় সেগুলাকে তাহারা ছাড়িয়া দিয়াছিল। সেগুলা এদিকে-ওদিকে কোথায় গিয়া পড়িয়াছে রাত্রে সন্ধানের উপায় নাই। হাঁস-মুরগিও প্রত্যেকের ছিল; তাহার কতকগুলা পুড়িয়াছে, চোখে দেখা না গেলেও গন্ধে তাহা অনুমান করা যায়। যেগুলা পলাইয়া বাঁচিয়াছে—সেগুলা ইতিমধ্যেই আসিয়া আপন আপন গৃহস্থের জটলার পাশে পালক ফুলাইয়া যথাসম্ভব দেহ সঙ্কুচিত করিয়া বসিয়া গেল। অন্য সম্পদের মধ্যে কতকগুলা মাটির হাড়ি, দুই-চারিটা পিতল-কাসার বাসন, ড়ো-কাপড়ে তৈয়ারি জীৰ্ণমলিন দুর্গন্ধযুক্ত কয়েকখানা কথা ও বালিশ, মাদুর চ্যাটাই, মাছ ধরিবার পলুই, দু-চারখানা কাপড়—তাহার কতক পুড়িয়াছে বা পোড়া-চালের ছাইয়ের মধ্যে চাপা পড়িয়াছে। যে যাহা বাহির করিয়াছে—সে সেগুলি আপনার পরিবার বেষ্টনীর মাঝখানে—যেন সকলে মিলিয়া বুক দিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছে। শেষরাত্রের হিমেল তীক্ষতায় কুণ্ডলী পাকাইয়া সকলে কিছুক্ষণের জন্য কাতর ক্লান্তির নীরবতার মধ্যে কখন নিদ্ৰাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।
সকাল হইতেই জাগিয়া উঠিয়া মেয়েরা আর এক দফা কাঁদয়া শোকোচ্ছাস প্রকাশ করিতে বসিল। একটু রোদ উঠিতেই কোমর বাঁধিয়া মেয়ে-পুরুষে পোড়া খড়ের ছাইগুলা ঝুড়িতে করিয়া আপন আপন সারগাদায় ফেলিয়া ঘর দুয়ার পরিষ্কার করিতে লাগিয়া গেল। পাকা কাঠগুলি একদিকে গাদা করিয়া রাখা হইল; পরে জ্বালানির কাজে লাগিবে। ছাইয়ের গাদার ভিতর হইতে চাপাপড়া বাসন যাহার যাহা ছিল—সেগুলি স্বতন্ত্র করিয়া রাখিল। এ সমস্ত কাজ ইহাদের মুখস্থ। গৃহের উপর দিয়া এমন বিপর্যয় ইহাদের প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। প্রবল বর্ষা হইলেও ঘরগুলির জীর্ণ আচ্ছাদন থুবড়াইয়া ভাঙিয়া পড়ে, নদীর বাঁধ ভাঙিলে বন্যার জল আসিয়া পাড়াটা ড়ুবাইয়া দেয়, ফলে দেওয়ালসুদ্ধ ঘরগুলি ধসিয়া পড়ে। মধ্যে মধ্যে জ্বালানির জন্য সংগৃহীত শুকনা পাতায় তামাকের আগুন ও জ্বলন্ত বিড়ির টুকরা ফেলিয়া মদ্যবিভোর নিশীথে নিজেরাই ঘরে আগুন লাগাইয়া ফেলে। সব বিপর্যয়ের পর সংসার গুছাইবার শিক্ষা এমনি করিয়া পুরুষানুক্রমেই ইহাদের হইয়া আসিতেছে। ঘর-দুয়ার পরিষ্কারের পর আহার্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে। গত সন্ধ্যার বাসি ভাতই ইহাদের সকালের খাদ্য, ছোট ছেলেদের মুড়ি দেওয়া হয়; কিন্তু ভাত বা মুড়ি সবই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। ছোট বাচ্চাগুলা ইহারই মধ্যে চিৎকার আরম্ভ করিয়া দিয়াছে কিন্তু তাহার আর উপায় নাই। দুই-একজন মা ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলার পিঠে দুমদাম করিয়া কিল-চড় বসাইয়া দিল। রাক্ষসদের প্যাটে যেন আগুন লেগেছে। মর মর তোরা, মর!
ঘরদুয়ার পরিষ্কার হইয়া গেলে মনিব-বাড়ি যাইতে হইবে—তবে আহার্যের ব্যবস্থা হইবে। মনিবেরা এসব ক্ষেত্রে চিরকালই তাহাদিগকে সাহায্য করিয়া থাকেন। এ পাড়ার প্রায় সকলেই চাষীদের অধীনে খাটে, বাধা বাৎসরিক বেতন বা উৎপন্ন ভাগের চুক্তিতে শ্রমিকের কাজ করে। কেহ কেহ পেট-ভাতায় বা মাসে ভাতের হিসাবমত ধান লইয়া থাকে এবং ছোটগুলা পেট-ভাতায় বৎসরে চারখানা সাত হাত কাপড় লইয়া রাখালি করে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ছেলেরা মাসে আট আনা হইতে এক টাকা পর্যন্ত মাহিনা পায়—ধানের পরিমাণও তাহাদের বেশি। পূর্ণ জোয়ানদের অধিকাংশই উৎপন্নের এক-তৃতীয়াংশ পাইবার চুক্তিতে চাষে শ্রমিকের কাজ করে। মনিব সমস্ত চাষের সময়টা ধান দিয়া ইহাদের সংসারের সংস্থান করিয়া দেয়—ফসল উঠিলে ভাগের সময় সুদসমেত ধান কাটিয়া লয়। সুদের হার প্রায় শতকরা পঁচিশ হইতে ত্রিশ পর্যন্ত। অজার বৎসরের এই ঋণ শোধ না হইলে আসল এবং সুদ এক করিয়া তাহার উপর আবার ওই হারে সুদ টানা হয়। এই প্রথার মধ্যে অন্যায় কিছু ইহারা বোধ করে না বরং সকৃতজ্ঞ আনুগত্যের ভাবই অন্তরে ইহার জন্য পোষণ করে। দায়-দৈবে মনিবেরা যে সাহায্য করেন সেইটাই অতিরিক্ত করুণা। সেই করুণার ভরসাতেই আহার্যের চিন্তায় এখন তাহারা খুব ব্যাকুল। নয়। মেয়েরাও অবস্থাপন্ন চাষী-গৃহস্থের ঘরে সকালে-বিকালে বাসন মাজে, আবর্জনা ফেলিয়া পাট-কাম করে। মেয়েরাও সেখান হইতে কিছু কিছু পাইবে। এ ছাড়া দুধের দাম কিছু কিছু পাওনা আছে। সে পাওনা কিন্তু গ্রামে নয়। চাষীর গ্রামে চাষীদের ঘরে দুধ হয়। হরিজনেরা তাদের গরুর দুধ পাশের বড়লোকের গ্রাম কঙ্কণায় গিয়া বেচিয়া আসে। খুঁটেও সেখানে বিক্রয় হয়। কেহ কেহ জংশনে যায়।