–মর, তুই মক্ রে! এমন রাগ তোর! একটু সবুর নাই! হাদাগাড়োল গোয়ার কোথাকার, পঞ্চাশ টাকা আমার খলখল করে বেরিয়ে গেল! আমার বুকে বাঁশ চাপিয়ে দে তুই—আমার হাড় জুড়োক।
শ্ৰীহরি সেদিকে কানই দিতেছে না। অন্য সময় হইলে এতক্ষণে সে বুড়ির চুলের মুঠো ধরিয়া উঠানে আছাড় মারিয়া ফেলিয়া নির্মম প্রহার আরম্ভ করি। কিন্তু আজ সে নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার চিন্তায় একেবারে মগ্ন হইয়া গিয়াছে।
অনিরুদ্ধ ওপার হইতে রাত্রি নটা-দশটার সময় ফেরে। অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণে না। সঙ্গে গিরিশ ছুতোর থাকে। থাকিলেই বা, দুজনকে ঘায়েল করিয়া দেওয়াই বা এমন কি কঠিন? শ্ৰীহরিরও মিতে আছে। মিতে গড়াঞী সানন্দে তাহাকে সাহায্য করিবে।
পরক্ষণেই সে চমকিয়া উঠিল। ধরা পড়িলে ফাঁসি হইয়া যাবে। তাহার সে চমক এত স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট যে তাঁহার ক্ষীণদৃষ্টি বুড়ি মা পর্যন্ত দেখিয়া ফেলিল। অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় সে বলিল—মর মুখপোড়া! ছোট ছেলের মত চমকে উঠে যেন দেয়ালা করছে।
শ্ৰীহরি অত্যন্ত কঠিন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে একবার ফিরিয়া চাহিল, পরক্ষণেই দৃষ্টি ফিরাইয়া হুঁকা হইতে কল্কেটা নামাইয়া দিয়া বলিল—এই! শুনচি? কল্কেটা পাল্টে দিয়ে যা।
কথাটা বলা হইল তাহার স্ত্রীকে। ছিরুর স্ত্রী রন্ধনশালে ভাতের হাঁড়ির দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। পাশেই ল্যাম্পের আলোয় ছিরু র বড় ছেলেটা বই খুলিয়া একদৃষ্টে বাপের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। শীর্ণ, রুণ, বছর দশেকের ছেলেটা-গলায় একবোঝ মাদুলি-বড় বড় চোখে অদ্ভুত স্থির মূঢ় দৃষ্টি। চিন্তাগ্ৰস্ত বাপের প্রতিটি ভঙ্গিমা সে লক্ষ্য করিতেছে। শ্ৰীহরির ছোট ছেলেটা প্রায়-পঙ্গু এবং বোবা, সেটাও একপাশে বসিয়া আছে মুখের লালায় সমস্ত বুকটা অনবরত ভিজিতেছে। বড় ছেলেটি উঠিয়া আসিয়া কল্কেটা লইয়া গেল। শ্ৰীহরি ছেলেটার দিকে একবার চাহিল। ছেলেটা অদ্ভুত, শ্ৰীহরির মার খাইয়াও কাঁদে না, স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে। ছেলেটার জন্য এখন তাহার মাকে প্রহার করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। মাকে যেন আগলাইয়া ফেরে। মারিলে পশুর মত হিংস্র হইয়া ওঠে। সেদিন সে প্রহাররত শ্ৰীহরির পিঠে একটা সুচ বিধাইয়া দিয়াছিল। ছেলেটার দিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া শ্ৰীহরি স্ত্রীর দিকে চাহিল—বিশীর্ণ গৌরবর্ণ মুখখানা উনানের আগুনের আভায় লাল হইয়া উঠিয়াছে—চামড়ায় ঢাকা কঙ্কালসার মুখ! শ্ৰীহরি দৃষ্টি ফিরাইয়া লইল।
হ্যাঁ, আর এক উপায় আছে! অনিরুদ্ধের অনুপস্থিতিতে পঁচিল ডিঙাইয়া পদ্ম কামারনীকে বাঘের মত মুখে করিয়া–শ্ৰীহরির বুকখানা ধকধক করিয়া লাফাইতে লাগিল। দীর্ঘাঙ্গী সবলদেহ কামারনীর সেই দা-খানা কিন্তু বড় শাণিত! চোখের দৃষ্টি তাহার শীতল এবং ক্র। সেদিন দা-খানার রৌদ্র প্রতিফলিত ছটায় ছিরুর চোখ ধাধিয়া গিয়াছিল।
বায়েনদের দুর্গা–কামারনীর চেয়ে দেখিতে অনেক সুী। যৌবন তাহার উচ্ছ্বসিত; দেহবর্ণে সে গৌরী; রঙ্গরসে, লীলা-লাস্যে সে অপরূপা। কিন্তু সে বহুভোগ্যা, সেই কারণেই তাহার আকর্ষণ শ্ৰীহরিকে আর তেমন বিচলিত করে না। দুর্গার দাদা পাতু আবার তাহার নামে জমিদারের কাছে নালিশ করিয়াছে। স্পৰ্ধা দেখ বায়েনের! শ্ৰীহরির মুখে তাচ্ছিল্যের ব্যঙ্গহাস্য ফুটিয়া উঠিল! জমিদারের ছেলের সোনার নিমফলের গোট তাহার কাছে বন্ধক আছে। অকস্মাৎ শ্ৰীহরি উঠিয়া পাঁড়াইল।
শ্ৰীহরির স্ত্রী কল্কেতে নতুন তামাক সাজিয়া আনিয়া নামাইয়া দিল। কিন্তু তামাক শ্ৰীহরিকে আর আকর্ষণ করিল না। দেওয়ালে-পো পেরেকে ঝুলানো জামাটা হইতে বিড়ি-দেশলাই বাহির করিয়া লইয়া সে চলিয়া গেল। অন্ধকার গলিপথে-পথে ঘুরিয়া সে হরিজন-পল্লীর প্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল।
প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে। পল্লীর প্রান্তে বহুকালের বৃদ্ধ বকুলগাছ, গ্রামের ধর্মরাজতলা সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় উহাদের মজলিস বসে। গান বাজনা হয়, ভাসান, বোলান, ঘেঁটু-গানের মহলা চলে—আবার এক-একদিনে দুর্নিবার কলহও বাঁধিয়া ওঠে। আজ কলহ বাঁধিয়াছে। শ্ৰীহরি একটা গাছের অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া কান পাতিয়া শুনিতে আরম্ভ করিল।
পাতু বায়েনই আস্ফালন করিয়া চিৎকার করিতেছে।
দুর্গারও তীক্ষকণ্ঠের আওয়াজ উঠিতেছে—ভাত দেবার ভাতার লয়, কিল মারার গোঁসাই। দাদা সাজছে, দা-দা! মারবি ক্যানে তু! আমার যা খুশি আমি তাই করব। হাজার নোক আসবে আমার ঘরে, তোর কি? তোর ভাত আমি খাই?
সঙ্গে সঙ্গে দুর্গার মা-ও চিৎকার করিতেছে। শ্ৰীহরি হাসিল,—ও! এ যে তাহাকে লইয়াই আন্দোলন চলিতেছে।
সহসা একটা মতলব তাহার মাথায় খেলিয়া গেল। গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া সে নিঃশব্দে অগ্রসর হইল দুৰ্গাদের বাড়ির দিকে। বকুলগাছটার ওপাশে পল্লীটা খাঁখাঁ করিতেছে। মেয়ে পুরুষ সব গিয়া জুটিয়াছে ওই গাছতলায়। শ্ৰীহরি সন্তৰ্পণে ঢুকিয়া পড়িল দুৰ্গাদের বাড়িতে। বাড়ি অর্থে প্রাচীর-বেষ্টনহীন এক টুকরো উঠানের দুইদিকে দুখানা ঘর, একখানা দুর্গা ও দুর্গার মায়ের অপরখানা পাতুর। শ্ৰীহরির তীক্ষ্ণদৃষ্টি পাতুর ঘরখানার দিকে। শ্ৰীহরি হতাশ হইল। দরজাটা বন্ধ-দাওয়াটাও শূন্য।
একটা কুকুর অকস্মাৎ গো গো শব্দ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল। বোধহয় চুরি করিয়া কাঁচা চামড়ার টুকরা খাইতে আসিয়াছিল। শ্ৰীহরি হাসিয়া একটা বিড়ি ধরাইল, সুকৌশলে হাতের মধ্যে সেটাকে সম্পূর্ণভাবে লুকাইয়া টানিতে টানিতে বাহির হইল। দুর্গার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে কে জানে? আবার সে গাছের আড়ালে আসিয়া দাঁড়াইল।