হরিশ মাতব্বরদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—এ দেবনাথ কিন্তু বলেছেন ভাল! কি বলেন গো সব?
ভবেশ বলিল—উত্তম কথা!
নটবর বলিল হাঁ, তাই করুন তা হলে।
দেবনাথের উৎসাহের সীমা ছিল না, সে বলিল-আজই বসুন সব সন্ধের সময়! আমি আসর করে দিচ্ছি, স্কুলের চল্লিশ বাতির আলো দিচ্ছি; খবরও দিচ্ছি সকলকে। কি বলছেন সব?
হরিশ আবার সকলের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কি গো?
—তা বেশ খানিকটা তামাক আর আগুনের যোগাড় রেখে বাপু।
****
বহুকাল পর চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাটা আবার আলোকোজ্জ্বল হইয়া গ্ৰাম্যমজলিসে জমিয়া উঠিল। ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই আটচালা ও চণ্ডীমণ্ডপ এমনিভাবে নিত্য সন্ধ্যায় জমজমাট হইয়া উঠিত। গ্রাম্য-বিচার হইত, সংকীর্তন হইত, পাশা-দাবাও চলিত; গ্রামখানির সলাপরামর্শের কেন্দ্ৰস্থল ছিল এই চণ্ডীমণ্ডপ ও আটচালা। গ্রামে কাহারও কোনো কুটুম্ব সজ্জন আসিলে—এই চণ্ডীমণ্ডপেই বসানো হইত। ক্রিয়া-কর্ম-অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ—সবই এইখানে অনুষ্ঠিত হইত। কালগতিকে ধুলার অবলেপনে অবলুপ্তপ্রায় বহু বসুধারার চিহ্ন এখনও শিবমন্দিরের দেওয়ালে এবং চণ্ডীমণ্ডপের থামের গায়ে অঙ্কিত দেখা যায়। তখন গ্রামে ব্যক্তিগত বৈঠকখানা বা বাহিরের ঘর কাহারও ছিল না। জগন ডাক্তারের পূর্বপুরুষ জগনের পিতামহই কবিরাজ হইয়া বাহিরের ঘর বা বৈঠকখানার পত্তন করিয়াছিল। প্রথমে সে অবশ্য এই চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়াই রোগী। দেখিত। তারপর অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও বটে এবং জমিদারের গোমস্তার সঙ্গে কি কয়েকটা কথান্তরের জন্যও বটে কবিরাজ ঔষধালয় ও বৈঠকখানা তৈয়ারি করিয়া ঔষধালয় খুলিল এবং সেখানে পান ও তামাকের সাচ্ছল্যে মজলিস জমাইয়া চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে ভাঙন ধরাইয়া দিল। তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে অনেকের বাড়িতেই একটি করিয়া বাহিরের ঘরের পত্তন হইয়াছে। সেইগুলিকে কেন্দ্ৰ করিয়াই সমগ্র গ্রাম জুড়িয়া এখন অনেকগুলি ছোট ছোট মজলিস বসে। কেহ। কেহ বা একাই একটি আলো জ্বালিয়া সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া। থাকে। তবে এখনও জগন ডাক্তারের ওখানেই মজলিসটি বড় হয়। জগনের রূঢ় দাম্ভিকতা সত্ত্বেও রোগীর বাড়ির লোকজন সেখানে যায়; আরও কয়েকজন যায়—ডাক্তারের অর্ধ-সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সংবাদের প্রত্যাশায়। দেবনাথ ঘোষ এত বিরূপতা সত্ত্বেও যায়। সেই চিৎকার করিয়া কাগজ পড়ে, অন্য সকলে শোনে। অসহযোগ আন্দোলন তখন শেষ হইয়াছে, স্বরাজপার্টির উগ্র বক্তৃতায় এবং সমালোচনায় কাগজের স্তম্ভগুলি পরিপূর্ণ। শ্রোতাদের মনে চমক লাগে—স্তিমিতগতি পল্লীবাসীর রক্তে যেন একটা উষ্ণ শিহরন অনুভূত হয়।
আজ চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে দেবনাথই সকলকে সম্ভাষণ জানাইতেছিল, সে-ই উদ্যোক্তা, মজলিস আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই আসর সে বেশ জমাইয়া তুলিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরের দেবস্থলের আঙিনায় পুরনো বকুল গাছটি গ্রামের ষষ্ঠীতলা, একটি বাসুদেব মূর্তি সেখানে গাছের শিকড়ের বন্ধনে একেবারে অ্যাঁটিয়া বসিয়া আছে; সেইটিই ষষ্ঠীদেবী বলিয়া পূজিত হয়। সেখানে একটা মোটা শুকনা ডাল জ্বালিয়া আগুন করা হইয়াছে। আগুনের চারিপাশে গ্রামের জনকতক হরিজন আসিয়া বসিয়া গিয়াছে। ভদ্ৰ সজ্জনেরা প্রায় সকলেই আসিয়াছে। কেবল দ্বারকা চৌধুরী, জগন ডাক্তার, ছিরু পাল এবং আরও দু-একজন এখনও আসে নাই।
চল্লিশ বাতির আলোয় আলোকিত চণ্ডীমণ্ডপটির উপরের দিকে চাহিয়া ভবেশ বলিল–দেখতে বেশ লাগছে বাপু।
হরিশও একবার চারিদিক দেখিয়া লইয়া বলিল—এইবার কিন্তু একবার মেরামত করতে হবে চণ্ডীমণ্ডপটিকে। বলিয়া সে সপ্রশংস কণ্ঠে বলিল—কি কাঠামো দেখ দেখি! ওঃ কি কাঠ!
দেবনাথ বলিল—ষড়দলে কি লেখা আছে জানেন?—যাবচ্চন্দ্রার্কমেদিনী। মানে চন্দ্ৰ-সূর্যপৃথিবী যতদিন থাকবে, এও ততদিন থাকবে।
—তা থাকবে বাপু। বলিহারি বলিহারি! ভবেশ পাল অকারণে উচ্ছ্বসিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিল।
ঠিক এই সময়েই দ্বারকা চৌধুরী লাঠি হাতে টুকটুক করিয়া আসিয়া বলিলেন—ওঃ, তলব যে বড় জোর গো!
দেবনাথ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া গেল; জগন ডাক্তার ও ছিরু র জন্য আবার সে দুটি ছেলেকে দুজনের কাছে পাঠাইয়া দিল। কিন্তু জগন ডাক্তার আসল না, সে স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছে—তাহার সময় নাই। চোখে চশমা লাগাইয়া সে নাকি খবরের কাগজ পড়িতেছে। ছিও আসে নাই; তাহার জ্বর হইয়াছে, তবে সে বলিয়াছে,-পাচজনে যা করবেন তাই আমার মত।
ছিরুর এই অযাচিত বিনয়ে দেবনাথ অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া গেল।
****
ছিরুর কথাটা অস্বাভাবিকতা দোষে দুষ্ট; বিনয়ের ধার ছিরু পাল ধারে না। জ্বর তাহার হয়ই নাই। সে নির্মম আক্ৰোশে গর্তের ভিতরকার আহত অজগরের মত মনে মনে পাক খাইয়া ঘুরিতেছিল। বাড়ির ভিতরে দাওয়ার উপর উবু হইয়া বসিয়া সে প্রকাও বড় কাটায় ক্রমাগত একঘেয়ে টান টানিয়া যাইতেছিল ও প্রখর নির্নিমেষ দৃষ্টিতে উঠানের একটা বিন্দুর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া ছিল। নানা চিন্তা তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিতেছে।
ঘরে আগুন লাগাইয়া দিলে কি হয়! মনটা আনন্দে চঞ্চল হইয়া ওঠে। পরক্ষণেই মনে হয়, না। সদ্য সদ্য আক্ৰোশের বশে একটা কিছু করিয়া বসিল আবার হয়ত ফ্যাসাদে পড়িতে হইবে। আজই পঞ্চাশ টাকা জমাদার বন্ধুকে দিতে হইয়াছে। ই লইয়া তাহার মা এখনও গজগজ করিয়া তাহাকে গালি পাড়িতেছে।