—ঠাকুরকে ভারি জব্দ করেছে। আধখানা কামিয়ে দিয়ে। আবার হাসিতে সে ভাঙিয়া পড়িল।
বহুকষ্টে হাস্য সংবরণ করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তারা নাপিত মহা ধূর্ত!
কাপড় ছাড়িয়া খাইতে বসিয়া এতক্ষণে অনিরুদ্ধ কোনোমতে কথাটা শেষ করিল। সেটা এই—তারা নাপিতও তাহাদের দেখাদেখি বলিয়াছে, ধান লইয়া গোটা বৎসর সমস্ত গ্রামের লোকের ক্ষৌরির কাজ সে করিতে পারিবে না। যাহাদের জমি নাই—হাল নাই—তাহাদের ধান পাওয়া যায় না। যাহাদের আছে তাহারাও সকলে দেয় না। সুতরাং ধান লইয়া ক্ষৌরির কারবার ছাড়িয়া সে নগদ কারবার শুরু করিয়াছে। হঠাকুর কামাইতে গিয়াছিল—তারা নাপিত পয়সা চাহিয়াছিল। খানিকটা বকাইয়া অবশেষে পয়সা দিব বলিয়াই হঠাকুর কামাইতে বসে।
অনিরুদ্ধ বলিল—তারা নাপিত—একে নাপিত ধূর্ত, তায় তারা। আধখানা কামিয়ে বলে–কই, পয়সা দাও ঠাকুর। হরু বলে—কাল দোব। তারাও অমনি ক্ষুর, ভাঁড় গুটিয়ে ঘরে ঢুকে বলে দিয়েছে—তা হলে আজ থাককাল বাকিটা কামিয়ে দেব। এই চেঁচামেচি গালাগালি-হিন্দি ফার্সি ইংরেজি। গাঁয়ের লোকেরা সব আবার জটলা পাকাচ্ছে।
অনিরুদ্ধ আবার প্রবল কৌতুকে হাসিয়া উঠিল এবং সে হাসির তোড়ে তোর মুখের ভাত ছিটাইয়া উঠানময় হইয়া গেল।
পদ্মের খানিকটা শুচি-বাতিক আছে; তাহার হুঁ-হাঁ করিয়া উঠিবার কথা, কারণ সব উচ্ছিষ্ট হইয়া যাইতেছে। কিন্তু আজ সে কিছুই বলিল না। অনিরুদ্ধের এত হাসিতেও সে এতক্ষণের মধ্যে একবার হাসে নাই। কথাটা অনিরুদ্ধের অকস্মাৎ মনে হইল। সে গভীর বিস্ময়ে পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল-তোর আজ কি হল বল্ দেখি?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পদ্ম বলিল—ছিরু পালের বউ লুকিয়ে এসেছিল।
–কে? বিস্ময়ে অনিরুদ্ধ সচকিত হইয়া উঠিল।
–ছিরু পালের বউ গো! তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত কথাগুলি বলিয়া পদ্ম কাপড়ের খুঁটেবাধা নোট দুইখানি দেখাইল।
অনিরুদ্ধ নীরব হইয়া রহিল।
পদ্ম আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আহা, মায়ের প্রাণ।
অনিরুদ্ধ আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া অকস্মাৎ গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া পড়িল, যেন। অ্যাঁকি দিয়াই নিজেকে টানিয়া তুলিল; বলিলবাবাঃ! রাজ্যের কাজ বাকি পড়ে গিয়েছে। এইবার খেয়েদেয়ে দেড় ক্ৰোশ পথ ছুটতে হবে।
পদ্ম কোনো কথা বলিল না। অনিরুদ্ধ হাত-মুখ ধুইয়া মসলা মুখে দিয়া একটা বিড়ি ধরাইল। এবং একমুখ হাসিয়া বলিল—একখানা নোট আমাকে দে দেখি।
পদ্ম কুঞ্চিত করিয়া অনিরুদ্ধের মুখের দিকে চাহিল। অনিরুদ্ধ আরও খানিকটা হাসিয়া বলিল ললাহা আর ইস্পাত কিনতে হবে পাঁচ টাকার। ছিরে শালাকে টাকা দিতে খদ্দেরের পাঁচ টাকা ভেঙেছি। আর
পদ্ম কোনো কথা না বলিয়া একখানা নোট অনিরুদ্ধের সম্মুখে ফেলিয়া দিল।
অনিরুদ্ধ কুড়াইয়া লইয়া হাসিয়া বলিল-আমি নিজে একটি–। মাইরি বলছি—একটি টাকার এক পয়সা বেশি খরচ করব না। কতদিন খাই নাই তুই বল?
অর্থাৎ মদ।
তবু পদ্ম কোনো কথা বলিল না। অকস্মাৎ যেন অনিরুদ্ধের উপর তাহার মন বিরূপ হইয়া উঠিয়াছে।
০৬. হরু ঘোষালের আধখানা দাড়ি
হরু ঘোষালের আধখানা দাড়ি কামাইয়া বাকিটা রাখিয়া দেওয়ায় তারা নাপিতের যতই পরিহাস-রসিকতা প্রকাশ পাইয়া থাকুক এবং গ্রামের লোকে প্রথমটা হরু ঘোষালের সেই অর্ধনারীশ্বরবৎ রূপ দেখিয়া হাসিয়া ব্যাপারটা যতই হাস্যকর করিয়া তুলুক,–প্রতিক্রিয়ার পালাটা কিন্তু সহজ ও আদৌ হাস্যকর হইল না; অত্যন্ত ঘোরালো এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল।
হরিশ মণ্ডল প্রবীণ মাতব্বর ব্যক্তি লোকটির সূক্ষ্ম বোধশক্তিও আছে। সে-ই প্রথম বলিল–হাসিস না তোরা, হাসির ব্যাপার এটা নয়। গায়ের অবস্থাটা কি হল একবার ভেবে দেখেছিস?
সকলেই হাসির বেগের প্রবলতা খানিকটা সংবরণ করিয়া হরিশের মুখের দিকে চাহিল। হরিশ গম্ভীরভাবে বলিল—ঘোর অরাজক।
ভবেশ পাল—ছির কাকাস্থূল ব্যক্তি, তবুও বুদ্ধিমত্তার ভান তাহার আছে, সে-ও গম্ভীর হইয়া বলিলতা বটে।
দেবনাথ হাসি-তামাশায় যোগ দিবার মত লোক নয়;সে ব্যাপারটা অনুমান করিয়া লইয়া বলিল—এ আপনারা আটকাবেন কি করে? গায়ের জোটান আছে আপনাদের? ওই কামার-ছুতোরের পঞ্চাইতি আসরে ছিরু দ্বারিক চৌধুরীর অপমান করলে, চৌধুরী উঠে চলে গেল, জগন ডাক্তার তো এই না—উন্টে অনিরুদ্ধকে উস্কে দিলে।
ভবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল হরিনাম সত্য হে! কলিশেষে এক বর্ণ হইবে যবন-এ কি আর মিথ্যা কথা বাবা? এমনি করেই ধৰ্মকৰ্ম্ম জাতজরম সব যাবে।
হরিশ বলিল-ওদিকে লুটনী দাই কি বলছে জান? আমার বউমায়ের নমাস চলছে তো! তাই বলে পাঠিয়েছিলাম যে, রাত-বিরেতে কোথাও যদি যাস তবে আগে খবর দিয়ে যাস যেন! তা বলেছে—আমাকে কিন্তু নগদ বিদেয় করতে হবে।
গভীর চিন্তায় বিভোর হইয়া ভবেশ বলিল—হুঁ।
হরিশ বলিরাজা বিনে রাজ্যনাশ যে বলে—কথাটা মিথ্যে নয়। আমাদের জমিদার যে হয়েছে সে থেকেও না থাকা!
দেবনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলিল—জমিদারের কথা বাদ দেন। জমিদার আমাদের খারাপ কিসের? এ কাজ তো জমিদারের নয়—আপনাদের। আপনারা কই শক্ত হয়ে বসে ডাকুন দেখি মজলিস। ঘাড় হেঁট করে সবাইকে আসতে হবে। আসবে নাচালাকি নাকি? বিপদ-আপদ কি নাই তাদের? লোহাতে মুড় বাধিয়ে ঘর করে সব? চৌধুরীকে ডাকুন-জগন ডাক্তারকে ডাকুন ডেকে আগে ঘর বুঝুন। তারপর কামার, ছুতোর, বায়েন, দাই, ধোপা, নাপিত এদের ডাকুন, আর ন্যায্য বিচার করুন। তাদের পাওনাটা কড়ায় গণ্ডায় পাবার ব্যবস্থা করতে হবে।