বিরক্তিতে ভ্ৰকুটি করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—বেলার পানে তাকিয়ে দেখেছিস? ছায়া কোথা গিয়েছে দেখ। এদিকে তিনটে বাজে।
গম্ভীর মুখে চকিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বাড়ির উঠানের ছায়া লক্ষ্য করিয়া পদ্ম গামছাখানা আনিয়া অনিরুদ্ধের হাতে দিয়া বুলিল—বস, আমি জল এনে দিই, বাড়িতেই চান করে নাও।
গামছাখানা কাঁধে ফেলিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তাতে দেরি হবে, পদ্ম। আমি এই যাব আর আসব। পানকৌড়ির মত ভুক করে ড়ুবব আর উঠব। ভাত তুই বেড়ে। বলিতে বলিতেই সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
পদ্ম ভাত বাড়িতে গিয়া রান্নাঘরের শিকলে হাত দিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। ডাল-তরকারি সব ঠাণ্ডা হিম হইয়া গিয়াছে। সেসব বাবুর মুখে রুচিবে কি? বাবু নয় নবাব। যত আয় তত ব্যয়। কামার, কুমার, নাপিত, স্বর্ণকারইহাদের অবশ্য খরচে বলিয়া চিরকাল বদনাম; কিন্তু উহার মত খরচে পদ্ম আর কাহাকেও দেখে না। ওপারের শহরে কামারশালা করিয়া খরচের বাতিক তাহার আরও বাড়িয়া গিয়াছে। এক টাকা সেরের ইলিশমাছ এ গ্রামে কে খাইয়াছে? এখন গরম একটা কিছু না করিয়া দিলে নবাব কেবল ভাতে-হাত করিয়াই উঠিয়া পড়িবে! খিড়কির ডোবাটার পাড়ে পদ্ম প্রথম আশ্বিনেই কয়েক ঝাড় পেঁয়াজ লাগাইয়াছিল, সেগুলো বেশ ঝাড়েগোছে বড় হইয়া উঠিয়াছে। পেঁয়াজের শাক আনিয়া ভাজিয়া দিলে কেমন হয়? পদ্ম খিড়কির দিকে অগ্রসর হইয়াই লক্ষ্য করিল—দুয়ারের পাশে কে যেন দাঁড়াইয়া আছে। সাদা কাপড়ের খানিকটা মধ্যে মধ্যে দেখা যাইতেছে। সে শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িয়া গেলগতকালের ছিরু পালের সেই বীভৎস হাসি! কয়েক পা পিছাইয়া আসিয়া সে প্রশ্ন করিল—কে? কে দাঁড়িয়ে গো?
সাড়া পাইয়া মানুষটি চকিত গতিতে ঘরে প্রবেশ করিল। পদ্ম আশ্বস্ত হইল—পুরুষ নয়, স্ত্রীলোক। পরমুহুর্তেই সে স্তম্ভিত হইয়া গেল-এ-যে ছিরু পালের বউ! বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হইবে না; এককালে সুন্দরী ছিল সে, কিন্তু এখন অকালবার্ধক্যে জীর্ণ এবং শীর্ণ। চোখে তাহার যত ক্লান্তি তত সকরুণ মিনতি। ছিরু পালের বউ বিনা ভূমিকায় দুটি হাত জোড় করিয়া সামনে দাঁড়াইয়া বলিল ভাই, কামার বউ।
পদ্ম কোনো কথা বলিতে পারিল না; ছিরু পালের বউকে সে ভাল করিয়াই জানে, এমন ভাল মেয়ে আর হয় না। কত বড় ভাল ঘরের মেয়ে সে তাও পদ্ম জানে। তাহার কতখানি দুঃখ তাও সে চোখে দেখিয়াছে, কানে শুনিয়াছে—ছিরু পালের প্রহার সে দূর হইতে স্বচক্ষে দেখিয়াছে; তদুপরি ছিরু র মায়ের গালিগালাজ সে নিত্যই শুনিতেছে।
ছিরুর বউ তাহার সম্মুখে আসিয়া ঈষৎ নত হইয়া বলিল—তোমার পায়ে ধরতে এসেছি ভাই।
দুই পা পিছাইয়া গিয়া পদ্ম বলিলনা-না-না সে কি?
–আমার ছেলে দুটিকে তোমরা গাল দিও না, ভাই; যে করেছে তাকে গাল দিও-কি বলব আমি তাতে!
ছিরু পালের সাতটি ছেলের মধ্যে দুইটি মাত্র অবশিষ্ট; তাও পৈতৃক গুপ্ত ব্যাধির বিষে জর্জরিত একটি রুণ, অপরটি প্রায় পঙ্গু!
সন্তানবতী নারীদের উপর বন্ধ্যা পদ্মের একটা অবচেতনগত হিংসা আছে। এই মুহূর্তে কিন্তু সে হিংসাও তাহার স্তব্ধ হইয়া গেল। সে আপনা-আপনি কেবলি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
ছিরু পালের স্ত্রী বলিল—তোমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। চাষীর মেয়ে—আমি জানি। তুমি ভাই এই টাকা কটা রাখ—বলিয়া সে স্তম্ভিত পদ্মের হাতে দুখানি দশ টাকার নোট জিয়া দিয়া আবার বলিল লুকিয়ে এসেছি, ভাই, জানতে পারলে আমার আর মাথা থাকবে না বলিয়াই সে দ্রুতপদে ফিরিল। দরজার মুখে গিয়া আবার একবার ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাত দুটি জোড় করিয়া বলিল-আমার ছেলে দুটির কোনো দোষ নাই ভাই। আমি হাত জোড় করে যাচ্ছি।
পরমুহূর্তে সে খিড়কির দরজার ওপাশে অদৃশ্য হইয়া গেল। পদ্ম যেন অসাড় নিস্পন্দ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল—
***
কিছুক্ষণ পরে তাহার এই স্তম্ভিত ভাব কাটিয়া গেল অদূরবর্তী একটা কোলাহলের আঘাতে। আবার একটা কোথায় গোলমাল বাঁধিয়া উঠিয়াছে। সকল কোলাহলের উর্ধ্বে একজনের গলা শোনা যাইতেছে। পদ্ম উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; অনিরুদ্ধ কি? না, সে নয়। তবে? ছিরু পাল? কান পাতিয়া শুনিয়া পদ্ম বুঝিলনা, এ ছি পালের কণ্ঠস্বরও নয়। তবে? সে দ্রুতপদে আসিয়া বাহির দরজার সম্মুখে পথের উপর নামিয়া দাঁড়াইল। এবার সে স্পষ্ট চিনিতে পারিল এ কণ্ঠস্বর এ গ্রামের একমাত্র ব্রাহ্মণ বাসিন্দা হরেন্দ্র ঘোষালের। পদ্ম এবার নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত দুই-ই হইল। মুখে খানিকটা ব্যঙ্গহাস্যও দেখা দিল। হরেন্দ্র ঘোষালের মাথায় বেশ খানিকটা ছিট আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। গ্রামের সকলকে টেক্কা দিয়া তাহার চলা চাই। ছিরু পাল সাইকেল কিনিলে, সে সাইকেল এবং কলের গান দুই-ই কিনিয়া ফেলিল, টাকা যোগাড় করিল জমি বন্ধক দিয়া। ছিরু পাল নাকি রহস্য করিয়া একবার রটনা করিয়াছিল—সে এবার ঘোড়া কিনিবে। হরেন্দ্র মান রক্ষার জন্য চিন্তিত হইয়া মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াছিল—ছিরু পাল ঘোড়া কিনিলে সে একটা হাতি কিনিবে। আজ আবার বামুনের কি বোঞ্ছ মাথায় চাপিয়াছে কে জানে? পথে। কোনো একটা ছোট ছেলেও নাই যে জিজ্ঞাসা করে।
ঠিক এই সময়েই পদ্ম দেখিল অনিরুদ্ধ আসিতেছে। কাছে আসিয়া পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া সে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
পদ্ম বলিল—মরণ-হাসছ কেন? অনিরুদ্ধ হাসিয়া প্রায় গড়াইয়া পড়িল।
—যা গেল! ব্যাপারটা বলে তবে তো মানুষে হাসে! এত চেঁচামেচি কিসের; হল কি? হরু ঠাকুর এমন চেঁচাচ্ছে কেন?