নদীর ওপারে নূতন মহাগ্রাম রচনা করিতেছেনূতন কাল। নূতন কালের সে রচনার মধ্যে যে রূপ ফুটিয়া উঠিবেসে যতীন বইয়ের মধ্যে পড়িয়াছে—তার জন্মস্থান কলিকাতায় প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে। সে মনে হইলে শিহরিয়া উঠিতে হয়, মনে হয় গোটা পৃথিবীর আলো নিভিয়া যাইবে, বায়ুপ্রবাহ স্তব্ধ হইবে, গোটা সৃষ্টিটা দুবৃত্ত-ধৰ্ষিতা নারীর মত অন্তঃসারশূন্য কাঙালিনীতে পরিণত হইবে। জীর্ণ অন্তর, বুকে হাহাকার, বাহিরে চাকচিক্য, মুখে কৃত্রিম হাসি। দুর্ভাগিনী সৃষ্টি! আঙ্কিক নিয়মে তার পরিণতিক্ষয়রোগীর মত তিলে তিলে মৃত্যু। তবু কিন্তু সে হতাশ নয় আজ। মানুষ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে অঙ্কশাস্ত্রের অতিরিক্ত রহস্য। পৃথিবীর সমুদ্রতটের বালুকারাশির মধ্যে একটি বালুকণার মতই ব্ৰহ্মাণ্ড-ব্যাপ্তির অভ্যন্তরে এই পৃথিবী, তাহার মধ্যে যে জীবনরহস্য, সে রহস্য ব্ৰহ্মাণ্ডের গ্ৰহ-উপগ্রহের রহস্যের ব্যতিক্রম—এক কণা পরিমাণ জীবন, প্রকৃতির প্রতিকূলতা মৃত্যুর অমোঘ শক্তি-সমস্তকে অতিক্ৰম করিয়া শত ধারায়, সহস্র ধারায়, লক্ষ ধারায়, কোটি কোটি ধারায় কালে কালে তালে তালে উচ্ছ্বসিত হইয়া মহাপ্রবাহে পরিণত হইয়া বহিয়া চলিয়াছে। সে সকল বাধাকেই অতিক্ৰম করিবে। আনন্দময়ী প্রাণবতী সৃষ্টি, অফুরন্ত তাহার শক্তি—সে তাহার জীবন-বিকাশের সকল প্রতিকূল শক্তিকে ধ্বংস করিবে, তাহাতে তাহার সংশয় নাই আজ। ভারতের জীবনপ্রবাহ বাধাবিঘ্ন ঠেলিয়া আবার ছুটিবে।
ন্যায়রত্ন জীর্ণ। তাঁহার কাল অতীত হইতে চলিয়াছে। তিনি থাকিবেন না। কিন্তু তাহার স্মৃতি আদর্শ নূতন জন্মলাভ করিবে।
যতীন হাসিল। মনে পড়িল ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথকে। সে আসিবে। দেবু ঘোষ। নবরূপে পল্লীর এই শৃঙ্খলাহীন যুগে, ভাঙাগড়ার আসরের মধ্যে শ্ৰীহরি পাল, কঙ্কণার বাবু, থানার জমাদার, দারোগার রক্তচক্ষুকে তুচ্ছ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, মহামারীর আক্রমণকে সে রোধ করিয়াছে। দেবুর বুকে বুক রাখিয়া আলিঙ্গনের সময় সে স্পষ্ট অনুভব করিয়াছে, অভয়ের বাণী তাহার বুকের মধ্যে আলোড়িত হইতে। সকল বাধা দূর করিয়া জীবনের সার্থকতা লাভের অদম্য আগ্রহের বাণী।
উত্তেজনায় বিপ্লববাদী শরীরে থরথর করিয়া কম্পন বহিয়া গেল। এ চিন্তা তাহার বিপ্লববাদের চিন্তা। আনন্দে তাহার চোখে ফুটিয়া উঠিল অদ্ভুত এক দীপ্তি। তাহার আনন্দ, তাহার সান্ত্বনা এই যে, সে তাহার কর্তব্য করিয়াছে। বন্দিজীবনে এই পল্লীর মধ্যে দেবুর জাগরণে সে সাহায্য করিয়াছে। বন্দিত্ব তাহার নিজের জীবনে জাগরণের ভাবপ্লাবনের গতিরোধ করিতে পারে নাই। এমনি করিয়াই নূতন কালের ধর্ষণ-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইবে মানুষ বাঁচিবে। ভয় নাই, ভয় নাই।
বাঁধের উপর দেবু দাঁড়াইয়া বলিল—যতীনবাবু, আসি তা হলে। নমস্কার।
যতীন বলিল—নমস্কার দেবুবাবু, বিদায়। দেবুর হাত দুইখানি নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করিয়া দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল; হঠাৎ থামিয়া আবৃত্তি করিল—
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী—ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।।
তারপর সে নিতান্ত অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া দ্রুতবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। দেবু যতীনের গতিপথের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। চোখ দিয়া তাহার দরদরধারে জল পড়িতে আরম্ভ করিল। এই একান্ত একক জীবন বিলু, খোকা চলিয়া গিয়াছে, জগন, হরেন আসিয়া আর তেমন কলরব করে না। সমস্ত গ্রাম হইতে সে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতেছে। আজ যতীনবাবুও চলিয়া গেল। কেমন করিয়া দিন কাটিবে তাহার? কাহাকে লইয়া বাঁচিয়া থাকিবে? সহসা মনে পড়িল ন্যায়রত্নের গল্প। কই, তাহার সে শালগ্রাম কই? সে ঊর্ধ্বলোকে আকাশের দিকে চাহিয়া আত্মহারার মত হাত বাড়াইল, সমস্ত অন্তর পরিপূর্ণ করিয়া অকপট-কাতর স্বরে ডাকিল ভগবান!
ময়ূরাক্ষীর গর্ভে নামিয়া যতীন আবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। সুউচ্চ বাঁধের উপর দণ্ডায়মান উর্ধ্ববাহু দেবুকে দেখিয়া সে আনন্দে তৃপ্তিতে মোহগ্ৰস্তের মত নিশ্চল হইয়া দেবুর দিকে চাহিয়া রহিল।
দারোগা ডাকিল যতীনবাবু, আসুন!
যতীন মাটিতে হাত ঠেকাইয়া, সেই হাত কপালে ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল। তারপর বলিল–চলুন।
অকস্মাৎ দূরে কোথাও ঢাক বাজিয়া উঠিল।
সেই দূরাগত ঢাকের শব্দে সচেতন হইয়া দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। ঢাক বাজিতেছে। মহাগ্রামে ঢাকের শব্দ। ন্যায়রত্নের বাড়িতে রথযাত্রা। রথ কোথায় গিয়া থামিবে কে জানে?
বাঁধের পথ ধরিয়া সে দ্রুতপদে অগ্রসর হইল।