দেবনাথ ঘোষের গলাটা যেমন তীক্ষ তেমনি উচ্চ, এ গ্রামে সকল কলরবের ঊর্ধ্বে তাহার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সে দুই অর্থেই। চাষীর ঘরে দেবনাথ যেন ব্যতিক্রম! তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিমান যুবক দেবনাথ; তাহার ছাত্র-জীবনে সে কৃতী ছাত্র ছিল। কিন্তু আৰ্থিক অসাচ্ছল্য এবং সাংসারিক বিপর্যয়হেতু ম্যাট্রিক ক্লাস হইতে তাহাকে পড়া ছাড়িতে হইয়াছে। সে এখন এই গ্রামেরই পাঠশালার পণ্ডিত। গ্রাম্যজীবনের ব্যবস্থা শৃঙ্খলার বহু তথ্য সে ব্যগ্ৰ কৌতূহলে অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছে। সে বলিতেছিল—কামার, ছুতোর, নাপিত কাজ করব না বললেই চলবে না। কাজ করতে তারা বাধ্য।
শ্ৰীহরি কেবল তেমনি গম্ভীরভাবে পাঁতে দাঁতে চাপিয়া বসিয়াছিল, এতখানি যে হইবে সে তাহা ভাবিতে পারে নাই। ওদিকে শ্রীহরির খামারবাড়িতে শুকাইতে দেওয়া ধান পায়ে পায়ে ওলটপালট করিয়া দিতে দিতে ছির মা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও নিষ্ঠুরতম আক্ৰোশে নির্মম অভিসম্পাত দিতেছিল অনিরুদ্ধকে।
***
অন্যদিকে অনিরুদ্ধের বাড়িতে পদ্ম উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে পথের দিকে চাহিয়া বাহির দরজাটিতে দাঁড়াইয়া ছিল। থানা-পুলিশকে তাহার বড় ভয়। ছিরু র মায়ের অশ্লীল গালিগালাজ এবং নিষ্ঠুর অভিসম্পাতগুলি এখান হইতে স্পষ্ট শোনা যাইতেছিল। ছিরু পালের বাড়ি এবং তাহাদের বাড়ির মধ্যে ব্যবধান মাত্র একটা পুকুরের এপার ওপার। শব্দ তেরছা ভাসিয়া আসে। পথটা তিনপাড় বেড় দিয়া খানিকটা ঘুর-পথ। গালাগালি শুনিয়া পদ্মের মুখখানা থমথমে হইয়া উঠিয়াছিল। পদ্ম দুরন্ত মুখরা মেয়ে; গালিগালাজ অভিসম্পাত সে-ও অনেক জানে। সে কাহারও স্পষ্ট নামোল্লেখ না করিয়া তাহাদের অবস্থার সহিত মিলাইয়া এমনভাবে অভিসম্পাত দিতে পারে যে শব্দভেদী বাণের মত উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির একেবারে বুকে গিয়া আমূল বিধিয়া যায়। কিন্তু আজ দারুণ উৎকণ্ঠায় কে যেন গলা চাপিয়া ধরিয়াছে। এই সময় অনিরুদ্ধ আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। অনিরুদ্ধকে দেখিয়া গভীর আশ্বাসে সে স্বস্তির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল; পরমুহুর্তেই চোখমুখ দীপ্ত করিয়া বলিল—শুনছ তো? আমিও এইবার গাল দেব কিন্তু!
অনিরুদ্ধের অবস্থাটা তখন ঠিক শীতের বরফের মত অনুতপ্ত, স্থির ও কঠিন। সে রুক্ষকণ্ঠে বলিলনা, গাল দিতে হবে না ঘরে চল।
পদ্ম ঘরের দিকে আসিতে আসিতে বলিল না। শুধু শুধু ঘরে যাব? কানের মাথা খেয়েছ? গালাগালগুলো শুনতে পাচ্ছ না?
—তবে যা, গাল দিগে; গলা ফাটিয়ে চিৎকার কর্ গিয়ে। মক্ গিয়ে।
পদ্ম গজগজ করিতে করিতে গিয়া ভাড়ার ঘর হইতে তেল বাহির করিয়া আনিয়া বলিল কি খোয়ারটা আমার করছে শুনতে পাচ্ছ না তুমি?
পদ্ম ও অনিরুদ্ধ নিঃসন্তান—তাই ছিরু র মা অনিরুদ্ধের নিষ্ঠুরতম মৃত্যু কামনা করিয়া পদ্মের জন্য কদৰ্যতম অশ্লীলতম ভবিষ্যৎ উপজীবিকার নির্দেশ দিয়া অভিসম্পাত দিতেছে। তেলের বাটি পাশে রাখিয়া সে স্বামীর একখানা হাত টানিয়া লইয়া তাহাতে তেল মাখাইতে বসিল। কর্কশ ও কঠিন হাত; আগুনের অ্যাঁচে রোমগুলি পুড়িয়া কামানো দাড়ির মত করকরে হইয়া আছে। শুধু হাত নয়, হাত-পা-বুকমোট কথা সম্মুখভাগের প্রায় অনাবৃত অংশটাই এমনি দগ্ধরোম। তেল দিতে দিতে পদ্ম বলিলবাবা, হাত-পা নয় যেন উখো!
অনিরুদ্ধ সে কথায় কান না দিয়া বলিল-আমার গুপ্তিটা বার করে বেশ করে মেজে রাখবি তো।
পদ্ম স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-আমারও দা আছে, কাল মেজে ঘষে শান দিয়ে রেখেছি, নিজের গলায় মেরে একদিন দু-খানা হয়ে পড়ে থাকব কিন্তু।
–কেন?
—তুমি খুনখারাপি করে ফাঁসি যাবেআর আমি হাড়ির ললাট ডোমের দুৰ্গতি ভোগ করে বেঁচে থাকব?
অনিরুদ্ধ কথার কোনো উত্তর দিল না, কেবল বলিল-হুঁ-উ!–অর্থাৎ পদ্মের হাড়ির ললাট ডোমের দুৰ্গতির সম্ভাবনার কথাটা সে ভাবিয়া দেখে নাই, নতুবা ছিরেকে জখম করিয়া জেল খাঁটিতে বা হত্যা করিয়া ফাসি যাইতে বর্তমানে তাহার বিশেষ আপত্তি ছিল না।
পদ্ম বলিল,—বারণ করলাম থানা পুলিশ কোরো না। কথা কানেই তুললে না! কিন্তু কি হল? পুলিশ কি করলে? গায়ের সঙ্গে কেবল ঝগড়া-বিবাদ বেড়ে গেল। আর আমি গাল দোব। বললেই একেবারে বাঘের মত অ্যাঁকিয়ে উঠছ—না দিতে পাবি না।
রুদ্ধক্রোধ অনিরুদ্ধ বিরক্তিতে অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল; কিন্তু কোনো কঠিন কথা বলিতে তাহার সাহসও হইল না, প্রবৃত্তিও হইল না। বন্ধ্যা পদ্মকে লইয়া তাহাকে বড় সন্তৰ্পণে চলিতে হয়; সামান্য কারণে নিতান্ত বালিকার মত সে অভিমান করিয়া মাথা খুঁড়িয়া, কাঁদিয়াকাটিয়া অনৰ্থ বাঁধাইয়া তোলে; আবার কখনও প্রবীণা প্ৰৌঢ়া যেমন দুরন্ত ছেলের আবদারঅত্যাচার সহ্য করে তেমনি করিয়া হাসিমুখে অনিরুদ্ধের অত্যাচার সহ্য করে অনিরুদ্ধের হাতে মার খাইয়াও তখন সে খিলখিল করিয়া হাসে। কখন কোন্ মুখে পদ্ম চলে—সে অনিরুদ্ধ অনেকটা বুঝিতে পারে। আজিকার কথার মধ্যে তাহার আবদারের সুর ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে; সেইটুকু বুঝিয়াই সে দারুণ বিরক্তি সত্ত্বেও আত্মসংবরণ করিয়া রহিল। কোনো কথা না বলিয়াই পদ্মর হাত হইতে সে আপনার পাখানা টানিয়া লইয়া বলিল-কই, গামছা কই?
পদ্ম কিন্তু এইটুকুতেই অভিমানে ফোঁস করিয়া উঠিল; অনিরুদ্ধ ভুল করে নাই। পদ্ম আজ ছোট মেয়ের মতই আবদেরে হইয়া উঠিয়াছে। মুখে সে কিছু বলিল না বটে, কিন্তু বিদ্যুতের মত চমকাইয়া মুখ তুলিয়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিল,-পরমুহূর্তেই তেলের বাটিটা তুলিয়া লইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।