প্রথমটা যতীন শঙ্কিত হইয়াছিল, ভাবিয়াছিল-পদ্ম হয়ত একটা কাণ্ড বাঁধাইয়া বসিবে। মূৰ্ছাব্যাধিগ্রস্ত পদ্ম হয়ত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িবে—এইটাই তাহার বড় আশঙ্কা হইয়াছিল। কিন্তু পদ্ম তাহাকে নিশ্চিন্ত করিয়া কেবল কাঁদিল। তাহার পাশে উচ্চিংড়ে-গোবরা বেশ শান্ত হইয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম তাহাকে কোনো কথা বলিল না।
উচ্চিংড়ে জিজ্ঞাসা করিল—তুমি চলে যাবা বাবু?
–হ্যাঁ। মা-মণির কাছে খুব ভাল হয়ে থাকবি, উচ্চিংড়ে। কেমন? আমি চিঠি দিয়ে খোঁজ নেব তোদের।
ঘাড় নাড়িয়া স্বীকার করিয়া উচ্চিংড়ে বলিল—আর তুমি ফিরে আসবা না বাবু?
যতীন ঘাড় নাড়িয়া হাসিতে গিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল—তারপর পদ্মকে বলিলমামণি, যেদিন ছাড়া পাব, একদিন তো ছেড়ে দেবেই, তোমার কাছে আসব।
পদ্ম চুপ করিয়াই রহিল।
এতক্ষণে পদ্ম নীরব রোদনের মধ্যেও মৃদু হাসিয়া হাতটি উপরের দিকে বাড়াইয়া দিয়া আকাশের দিকে চাহিল।
যতীনের চোখে জল আসিল। আত্মসংবরণ করিয়া সে বলিল যখন যা হবে, পণ্ডিতকে বলবে তার পরামর্শ নেবে।
পদ্মের মুখ এবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিলা, পণ্ডিত আছে। চোখ মুছিয়া এবার সে বলিল–সাবধানে থেকো তুমি।
নলিন, সেই চিত্রকর ছেলেটিও ভিড়ের মধ্যে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সে নীরবে অগ্রসর হইয়া আসিয়া চুপ করিয়া একটি প্রণাম করিয়া, অভ্যাসমত নীরবেই চলিয়া গেল।
যতীন তাহার দিকে চাহিয়া হাসিল।
হরেন হাত ধরিয়া বলিল–গুডবাই ব্রাদার।
জগন বলিল রিলিজড হলে যেন খবর পাই।
সতীশ বাউরি আসিয়া প্ৰণাম করিয়া একখানি ভঁজ করা ময়লা কাগজ তাহার দিকে বাড়াইয়া একমুখ বোকার হাসি হাসিয়া বলিল-আমাদের গান। নিকে নিতে চেয়েছিলেন আপুনি। অনেকদিন নিকিয়ে রেখেছি, দেয়া হয় নাই।
যতীন কাগজখানি লইয়া সযত্নে পকেটে রাখিল।
আশ্চর্য! দুৰ্গা আসে নাই!
দারোগাবাবু বলিল—এইবার চলুন যতীনবাবু।
যতীন অগ্রসর হইল–চলুন।
দেবু তাহার পাশে পাশে চলিল। পিছনে জগন, হরেন, আরও অনেকে চলিল। পথে চণ্ডীমণ্ডপের ধারে শ্ৰীহরি ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। মজুরেরা চণ্ডীমণ্ডপের খড়ের চাল খুলিয়া দিতেছে, বর্ষার জলে ওটা ভাঙিয়া পড়িবে। তারপর সে আরম্ভ করিবে–ঠাকুরবাড়ি। শ্ৰীহরি ঘোষও মৃদু। হাসিয়া তাহাকে ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিল।
গ্রাম পার হইয়া তাহারা মাঠে আসিয়া পড়িল। যতীন বলিল-ফিরুন এবার আপনারা।
সকলেই ফিরিল। কেবল দেবু বলিল—চলুন, আমি বঁধ পর্যন্ত যাব। ওখান থেকে মহাগ্রামে যাব ঠাকুর মশায়ের বাড়ি। তার ওখানে রথযাত্রা।
পথে নির্জন একটি মাঠের পুকুরপাড়ে গাছতলায় দাঁড়াইয়া ছিল দুর্গা। তাহাকে কেহ দেখিল না। কিন্তু সে তাহাদের দিকে চাহিয়া যেমন দাঁড়াইয়া ছিল—তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।
সকলেই চলিতেছিল নীরবে। একটি বিতায় সকলেই যেন কথা হারাইয়া ফেলিয়াছে। দারোগাবাবুটিও নীরব। এতগুলি মানুষের মিলিত বিষণ্ণতা তাহার মনকে তাহার অজ্ঞাতসারেই
স্পৰ্শ করিয়াছে।
যতীনের মনে পড়িতেছিল—অনেক কিছু কথা, ছোটখাটো স্মৃতি। সহসা মাঠের দিকে চাহিয়া তাহার ভাবান্তর উপস্থিত হইল। এই বিস্তীর্ণ মাঠ একদিন সবুজ ধানে ভরিয়া উঠিবে, ধীরে ধীরে হেমন্তে স্বৰ্ণবর্ণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে। চাষীর ঘর ভরিবে রাশি রাশি সোনার ফসলে।
পরমুহুর্তেই মনে হইল-তারপর? সে ধান কোথায় যাইবে?
তাহার মনে পড়িল অনিরুদ্ধের সংসারের ছবি। আরও অনেকের ঘরের কথা। জীর্ণ ঘর, রিক্ত অঙ্গন, অভাবক্লিষ্ট মানুষের মুখ, মহামারী, ম্যালেরিয়া, ঋণভার; শীর্ণকায় অর্ধ-উলঙ্গ অজ্ঞ শিশুর দল। উচ্চিংড়ে ও গোবরা বাংলার ভাবী-পুরুষের নমুনা।
পরক্ষণেই মনে পড়িল-পদ্ম তাহাদের কপালে অশোক-ষষ্ঠীর ফোঁটা দিতেছে।
হঠাৎ তাহার পড়া স্ট্যাটিস্টিক্সের কথা তুচ্ছ মনে হইল। অর্ধসত্য—সে শুধু কঠিন বস্তুগত হিসাব। কিন্তু সংসারটা শুধু হিসাব নয়। কথাটা তাহাকে একদিন ন্যায়রত্ন বলিয়াছিলেন। তাহাকে মনে পড়িয়া গেল। সে অবনত মস্তকে বারবার তাঁহাকে প্রণাম জানাইয়া স্বীকার করিল—সংসার ও সংসারের কোনো কোনো মানুষ হিসাবের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। ন্যায়রত্ন হিসাবের ঊর্ধ্বেপরিমাপের অতিরিক্ত। আরও তাহার পাশের এই মানুষটি পণ্ডিত দেবু ঘোষ, অর্ধশিক্ষিত চাষীর ছেলে, হৃদয়ের প্রসারতায় তাহার নির্ধারিত মূল্যাঙ্ককে ছাড়াইয়া গিয়াছে। কতখানিকতদূর যতীন তাহা নির্ধারিত করিতে পারে নাই, কেমন করিয়া গেল—সেও অঙ্কশাস্ত্রের অতিরিক্ত এক রহস্য।
এই হিসাব-ভুলের ফেরেই তো সৃষ্টি বাঁচিয়া আছে। এক ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর একবার চুরমার হইয়া যাইবার কথা ছিল। বিরাট বিরাট হিসাব করিয়া ও অঙ্ক কষিয়াই সেটা অঙ্কফল হিসাবেই ঘোষিত হইয়াছিল। অঙ্ক ভুল হয় নাই, কিন্তু পৃথিবী কোন রহস্যময়ের ইঙ্গিতে ভুল করিয়া ধূমকেতুটার পাশ কাটাইয়া বাঁচিয়া গিয়াছে।
নহিলে সেই সমাজ-শৃঙ্খলার সবই তো ভাঙিয়া গিয়াছে। গ্রামের সনাতন ব্যবস্থা নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতিআজ স্বকর্মত্যাগী, স্বকর্মহীন। এক গ্রাম হইতে পঞ্চগ্রামের বন্ধন, পঞ্চগ্রাম হইতে সপ্তগ্রাম, নবগ্রাম, দশগ্রাম, বিংশতি গ্রাম, শগ্রাম, সহস্রগ্রামের বন্ধন-রঞ্জু গ্ৰন্থিতে গ্রন্থিতে এলাইয়া গিয়াছে।
মহাগ্রামের মহা বিশেষণ বিকৃত হইয়া মহুতে পরিণত হইয়াছে, শুধু শব্দার্থেই নয়–বাস্তব পরিণতিতেও তাহার মহা-মহিমত্ব বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। আঠার পাড়া গ্রাম আজ মাত্র অল্প কয়েক ঘর লোকের বসতিতে পরিণত। ন্যায়রত্ন জীৰ্ণ বৃদ্ধ একান্তে মহাপ্রয়াণের দিন গণনা করিয়া চলিয়াছেন।