—তাই তো! অনি-ভাইয়ের তো এতদিনে ফেরা উচিত ছিল।
–আমি ভাবছি—জেলে আবার কোনো হাঙ্গামা করে নতুন করে মেয়াদ হল না তো?
বিচিত্র নয়। অনি-ভাইকে বিশ্বাস নাই। গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, দুর্দান্ত ক্রোধী। অনিরুদ্ধ সব পারে। দেবু বলিল-কামার-বউ বোধহয় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে?
যতীন হাসিলমা-মণি? দেবুবাবু, ও এক বিচিত্র মানুষ। দেখছেন না-বাউণ্ডুলে ছেলে দুটো আর কোথাও যায় না। বাড়ির আশপাশেই ঘুরছে দিনরাত। মা-মণি ওই ওদের নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত। একদিন মাত্র অনিরুদ্ধের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। ব্যস। আবার যেদিন মনে পড়বে জিজ্ঞাসা করবে।
দেবুর চোখে এই তুচ্ছ কারণে জল আসিল। খোকাকে কোলে করিয়া বিলুর হাসিভরা মুখ, ব্যস্তসমস্ত দিনের কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল। যতীন বলিলবরং দুর্গা আমাকে দু-তিন দিন জিজ্ঞাসা করেছে।
চোখ মুছিয়া দেবু হাসিল, বলিল-দুর্গা আমার ওদিক দিয়ে অজকাল বড় যায় না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম তো বললেগাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশি গেলে-এলেই–তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে।
সত্য কথা। দুৰ্গা দেবুর বাড়ি বড় একটা যায় না। কিন্তু তাহার মাকে পাঠায় দুধ দিতে, পাতুকে পাঠায় দুবেলা। রাত্রে পাতুই দেবুর বাড়িতে শুইয়া থাকে, সে-ও দুর্গার বন্দোবস্ত। তা ছাড়া সে-ও যেন কেমন হইয়া গিয়াছে। সে আর লীলাচঞ্চলা তরঙ্গময়ী নাই। আশ্চর্য রকমের শান্ত হইয়া গিয়াছে। বোধহয় দেবুর ছোঁয়া লাগিয়াছে তাহাকে। যতীনের কিশোর তরুণ রূপ তাহাকে আর বিচলিত করে না। সে মাঝে মাঝে দূর হইতে দেবুকে দেখেতাহারই মত উদাস দৃষ্টিতে পৃথিবীর দিকে নিরর্থক চাহিয়া থাকে।
যতীন কিছুক্ষণ পরে বলিল—শুনেছি শ্ৰীহরি ঘোষ সদরে দরখাস্ত করেছে গ্রামে প্রজাধর্মঘটের আয়োজন হচ্ছে, তার মূলে আমি আছি। আমাকে সরাবার চেষ্টা করছেন। সরতেও আমাকে হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই স্নেহপাগলিনী মেয়েটির জন্য যে ভেবে আকুল হচ্ছি। এক ভরসা আপনি আছেন। কিন্তু সে-ও তো এক ঝঞাট। তা ছাড়া এ এক অদ্ভুত মেয়ে, দেবুবাবু; ওই দুটো ছেলেকে আবার জুটিয়েছে। খাবে কি, দিন চলবে কি করে? আমি গেলেই ঘর ভাড়া দশ টাকা তো বন্ধ হয়ে যাবে। আজকাল মা-মণি ধান ভানে, কঙ্কণায় ভদ্রলোকদের বাড়িতে গিয়ে মুড়ি ভাজে। কিন্তু ওতে কি ওই ছেলে দুটোসমেত সংসার চলবে?
কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া দেবু বলিল—জেল-অফিস ভিন্ন তো অনিরুদ্ধের সঠিক খবর পাওয়া যাবে না। আমি বরং একবার সদরে গিয়ে খোঁজ করে আসি।
সদরে গিয়া দেবু দুই দিন ফিরিল না।
যতীন আরও চিন্তিত হইয়া উঠিল। অপর কেহ এ সংবাদ জানে না। পদ্মও জানে না। তৃতীয় দিনের দিন দেবু ফিরিল। অনিরুদ্ধের সংবাদ পাওয়া যায় নাই। জেল হইতে সে বাহির হইয়াছে দশ দিন আগে। দেবু অনেক সন্ধান করিয়াছে, সেই জন্য দুই দিন দেরি হইয়াছে। জেল হইতে বাহির হইয়া একটা দিন সে শহরেই ছিল দ্বিতীয় দিন জংশন পর্যন্ত আসিয়াছিল। সেখানে হইতে নাকি একটি স্ত্রীলোককে লইয়া সে চলিয়া গিয়াছে। এই পর্যন্ত সংবাদ মিলিয়াছে যে কলে কাজ করিবার জন্য সে কলিকাতা বা বোম্বাই বা দিল্লি বা লাহোরে গিয়াছে। অন্তত সেই কথাই সে বলিয়া গিয়াছে—কলে কাজ করব তো এখানে কেন করব? বড় কলে কাজ করব। কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লি, লাহোর যেখানে বেশি মাইনে পাব, যাব।
বাড়ির ভিতর শিকল নড়িয়া উঠিল।
যতীন ও দেবু উভয়েই চমকিয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল। আবার শিকল নড়িল। যতীন এবার উঠিয়া গিয়া নৃতশিরে অপরাধীর মত পদ্মের সম্মুখে দাঁড়াইল।
পদ্ম জিজ্ঞাসা করিল—সে জেল থেকে বেরিয়ে কি কোথাও চলে গেছে?
–হ্যাঁ।
–কলকাতা, বোম্বাই?
–হ্যাঁ।
পদ্ম আর কোনো প্রশ্ন করিল না। ফিরিয়া চুপ করিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিল। সে চলিয়া গিয়াছে। যাক। তার ধর্ম তার কাছে!
তাহার এ মূর্তি দেখিয়া যতীন আজ আর বিস্মিত হইল না। পদ্ম বিষণ্ণ মূর্তিতে বসিতেই গোবরা ও উচ্চিংড়ে আসিয়া চুপ করিয়া পাশে বসিল। যতীন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া দেবুর নিকট ফিরিয়া আসিল।
***
দিন চারেক পর। সেদিন রথের দিন।
গত রাত্রি হইতে নববর্ষার বর্ষণ শুরু হইয়াছে। আকাশভাঙা বর্ষণে চারিদিক জলে থইথই করিতেছে। কাড়ান লাগিয়াছে। প্ৰচণ্ড বৰ্ষণের মধ্যে মাথালি মাথায় দিয়া চাষীরা মাঠে কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। জমির আইলের কাটা মুখ বন্ধ করিতেছে, ইদুরের গর্ত বন্ধ করিতেছে, জল আটক করিতে হইবে। পায়ের নিচে মাটি মাখনের মত নরম, সেই মাটি হইতে সোঁদা গন্ধ বাহির হইতেছে। সাদা জলপরিপূর্ণ মাঠ চকচক করিতেছে মেঘলা দিনের আলোর প্রতিফলনে। মধ্যে মধ্যে বীজধানের জমিতে সবুজ সতেজ ধানের চারা চাপ বাঁধিয়া এক-একখানি সবুজ গালিচার আসনের মত জাগিয়া আছে। বাতাসে ধানের চারাগুলি দুলিতেছে—যেন অদৃশ্য লক্ষ্মীদেবী মেঘলোক হইতে নামিয়া কোমল চরণপাতে পৃথিবীর বুকে আসিয়া আসন গ্রহণ করিবেন বলিয়া চাষীরা আসনখানি পাতিয়া রাখিয়াছে।
সেই বৰ্ষণের মধ্যে যতীন বাসা ছাড়িয়া পথে নামিল। তাহার সঙ্গে দারোগাবাবু। দুই জন। চৌকিদারের মাথায় তাহার জিনিসপত্র। দেবু, জগন, হরেন—গ্রামের প্রায় যাবতীয় লোক সেই বৰ্ষণের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে।
যতীনের অনুমান সত্য হইয়াছে। তাহার এখান হইতে চলিয়া যাইবার আদেশ আসিয়াছে। সদর শহরে—একেবারে কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির সম্মুখে রাখার ব্যবস্থা হইয়াছে এবার। দুয়ার। ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে ম্লানমুখী পদ্ম; আজ তাহার মাথায় অবগুণ্ঠন নাই। দুই চোখ দিয়া তাহার জলের ধারা গড়াইতেছে। তাহার পাশে উচ্চিংড়ে ও গোবরা স্তব্ধ, বিষণ্ণ।