***
কাহার কণ্ঠধ্বনি বাজিয়া উঠিল।–-পণ্ডিত!
দেবুর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন ন্যায়রত্ব; তাহার সঙ্গে যতীন, পিছনে লণ্ঠন হাতে আর একটি লোক।
—আপনি? কিন্তু আমাকে তো—
–চল, বাড়ির ভেতর চল।
–আমাকে তো প্রণাম করতে নাই—আমার অশৌচ।
সস্নেহে তাহার মাথায় হাত দিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন—অশৌচ! তিনি মৃদু হাসিলেন। একটা কিছু আন পণ্ডিত, এইখানে এই উঠোনেই বসা যাক। ঘরের ভেতর থেকে ঘুমন্ত লোকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন। থাক, যারা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। তোমার সঙ্গে নিরালায় একটু আলাপ করব বলে এত রাত্রে আমার আসা। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আসতে ইচ্ছা হল। না, পথে যতীন ভায়া সঙ্গ নিলেন। এঁদের দৃষ্টি জাগ্রত তপস্বীর মত। ফাঁকি দিতে পারলাম না। দেখলাম আকাশের দিকে চেয়ে উনিও বসে আছেন তোমার মত। আমাকে বললেন—তোমার এই নিষ্ঠুর বিপর্যয়ের জন্য উনিই দায়ী। ওঁর চোখে জল ছলছল করে উঠল। তাই ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। আমাদের সুখ-দুঃখের কথায় উনিও অংশীদার হবেন।
ন্যায়রত্ন হাসিলেন। এ হাসি সুখের নয়—দুঃখেরও নয়—এক বিচিত্র দিব্য হাসি।
দেবুও হাসিল। ন্যায়রত্বের হাসির প্রতিবিম্বটিই যেন ফুটিয়া উঠিল। ঘর হইতে একটি মোড়া আনিয়া পাতিয়া দিয়া সে বলিল—বসুন।
ন্যায়রত্ন বসিয়া বলিলেন—বস, আমার কাছে বস। বস যতীন ভায়া, বস।
তাহারা মাটির উপরেই বসিয়া পড়িল। দেবু বলিল—এই সেদিন পরমশ্রদ্ধায় বিলু আপনার পা ধুইয়ে দিয়েছিল কিন্তু আজ আজ সে কোথায়!
ন্যায়রত্ন তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেনদেবু-ভাই, আমি সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলাম এই পরিণামের দিকেই তুমি এগিয়ে চলেছ। তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম,
তোমার স্ত্রীকে দেখেও বুঝেছিলাম।
দেবু ও যতীন উভয়ে বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
ন্যায়রত্ন যতীনের দিকে চাহিয়া বলিলেন—সেদিনের গল্পটা মনে আছে বাবা! সবটা সেদিন বলি নি। বলি শোন। গল্প এখন ভাল লাগবে তো?
দেবু সাগ্রহে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–বলুন।
ন্যায়রত্ন আরম্ভ করিলেন—সেই ব্ৰাহ্মণ ধনবলে আবার আপন সৌভাগ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেন। পুত্ৰ-কন্যা-জামাতায়, পৌত্র-পৌত্রী-দৌহিত্র-দৌহিত্রীতে সংসার হয়ে উঠল—দেববৃক্ষের সঙ্গে তুলনীয়। ফলে অমৃতের স্বাদ ফুলে অগুরু-চন্দনকে লজ্জা দেয় এমন গন্ধ। কোনো ফল অকালে ঘৃত হয় না, কোনো ফুল অকালে শুষ্ক হয় না।
পরিপূর্ণ সংসার তার, আনন্দে শান্তিতে সুখে স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল। ছেলেরাও প্রত্যেকে বড় বড় পণ্ডিত, জামাতারাও তাই। প্রত্যেকেই দেশান্তরে স্বকর্মে প্রতিষ্ঠিত। কেউ কোনো রাজার কুলপণ্ডিত, কেউ সভাপণ্ডিত, কেউ বড় টোলের অধ্যাপক। ব্রাহ্মণ আপন গ্রামেই থাকেন আপন কর্ম করেন।
একদিন তিনি হাঁটে গিয়ে এক মেছুনীর ডালার দিকে চেয়ে চমকে উঠলেন। মেছুনীর ডালায় একটি কালো রঙের সুডৌল পাথর, গায়ে কতকগুলি চিহ্ন। তিনি চিনলেন, নারায়ণ-শিলা শালগ্ৰাম। মেছুনীর এই অপবিত্র ডালায় আমিষ গন্ধের মধ্যে পূত নারায়ণ-শিলা! তিনি চমকে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই মেছুনীকে বললেন মা, ওটি তুমি কোথায় পেলে?
মেছুনী একগাল হেসে প্রণাম করে বলল-বাবা, ওটি নদীর ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছি, ঠিক একপো ওজন; বাটখারা করেছি ওটিকে। ভারি পয় আমার বাটখারাটির। যেদিন থেকে এটি পেয়েছি—সেদিন থেকে আমার বাড়বাড়ন্তর আর সীমা নেই।
সত্য কথা। মেছুনীর এক-গা সোনার গহনা।
ব্রাহ্মণ বললেন–দেখ মা, এটি হল শালগ্রাম-শিলা। ঐ আমিষের মধ্যে এঁকে রেখে দিয়েছ–ওতে তোমার মহা-অপরাধ হবে।
মেছুনী হেসেই সারা।
ব্রাহ্মণ বললেন–ওটি তুমি আমাকে দাও। আমি তোমায় কিছু টাকা দিচ্ছি। পাঁচ টাকা দিচ্ছি তোমাকে।
মেছুনী বললে–না বাবা। এটি আমি বেচব না।
—বেশ, দশ টাকা নাও!
–না, বাবা-ঠাকুর। ও আমাকে অনেক দশ টাকা পাইয়ে দেবে।
–বেশ, কুড়ি টাকা।
–না বাবা। তোমাকে জোড়হাত করছি।
–আচ্ছা, পঞ্চাশ টাকা!
–হবে না।
–একসো!
–না গো, না।
–এক হাজার!
মেছুনী এবার ব্রাহ্মণের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কোনো উত্তর দিল না; দিতে পারল না।
–পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি তোমায়!
এবার মেছুনী আর লোভ সংবরণ করতে পারল না। ব্রাহ্মণ তাকে পাঁচটি হাজার টাকা গুনে দিয়ে নারায়ণকে এনে গৃহে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, প্রথম দিনেই ব্ৰাহ্মণ স্বপ্ন দেখলেন—একটি জ্যোতির্ময় দুরন্ত কিশোর তার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে তাকে বলছে—আমাকে কেন তুমি মেছুনীর ডালা থেকে নিয়ে এলে? আমি সেখানে বেশ ছিলাম। যাও, এখুনি ফিরিয়ে দিয়ে এস আমাকে।
ব্ৰাহ্মণ বিস্মিত হলেন।
দ্বিতীয় দিনেও আবার সেই স্বপ্ন। তৃতীয় দিনের দিনে স্বপ্নে দেখলেন কিশোরের ভীষণ উগ্ৰমূর্তি। বললেন—ফিরিয়ে দিয়ে এস, নইলে কিন্তু তোমার সর্বনাশ হবে।
সকালে উঠে সেদিন তিনি গৃহিণীকে সব বললেন। এতদিন স্বপ্নের কথাটা প্রকাশ করেন নি, বলেন নি। আজ আর না বলে পারলেন না।
গৃহিণী উত্তর দিলেন-তাই বলে নারায়ণকে পরিত্যাগ করবে নাকি? যা হয় হবে। ও চিন্তা তুমি কোরো না।
রাত্রে আবার সেই স্বপ্ন, আবার–আবার। তখন তিনি পুত্ৰ-জামাতাদের এই স্বপ্ন-বিবরণ লিখে জানতে চাইলেন তাদের মতামত। মতামত এল, সকলেরই এক জবাব-গৃহিণী যা বলেছিলেন তাই।
সেদিন রাত্রে স্বপ্নে তিনি নিজে উত্তর দিলেন, ঠাকুর, কেন তুমি রোজ এসে আমার নিদ্রার ব্যাঘাত কর, বল তো? কাজে-কর্মে-বাক্যে-চিন্তায় আমার জবাব কি তুমি আজও পাও নি? আমিষের ডালায় তোমাকে আমি রেখে দিতে পারব না।