বৈজ্ঞানিক সত্য ধর্মবিশ্বাসের কণ্ঠরোধ করিয়া শেষে কি তাহার গৃহেই রুদ্রমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিল?
***
সর্বনাশী মহামারী মানবদেহের সকল রস দ্রুত শোষণ করিয়া জীবনীশক্তিকে নিঃশেষিত করিয়া দেয়। সেই মহামারী দেবুর সকল রস, সকল কোমলতা নিষ্ঠুর পেষণে পিষ্ট করিয়া পাথর করিয়া দিয়া তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। একা খোকা নয়, খোকা ও বিলুদুজনেই কলেরায় মারা গেল। প্রথম দিন খোকা, দ্বিতীয় দিন বিলু। শুশ্রুষা ও চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়। নাই। জংশন শহর হইতে রেলের ডাক্তার, কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তার দুই জন বড় ডাক্তার। আনা হইয়াছিল। কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তারটি সংবাদ পাইয়া আপন হইতেই আসিয়াছিল। লোকটি গুণগ্রাহী, দেবুর প্রতি শ্রদ্ধাবশতই আসিয়াছিল। জগন নিজে জংশনে গিয়া রেলের ডাক্তারকে আনিয়াছিল। অনাহারে অনিদ্রায় দেবু অকাতরে তাহাদের সেবা করিয়াছে আর ঈশ্বরের নিকট মাথা খুঁড়িয়াছে—দেবতার নিকট মানত করিয়াছে। দুর্গাও কয়দিন প্ৰাণপণে তাহার সাহায্য করিয়াছে। জগন ডাক্তারের তো কথাই নাই; যতীন, সতীশ, গদাই, পাতু দুই। বেলা আসিয়া তত্ত্ব লইয়া গিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। দেবু পাথরের মত অশ্রুহীন নেত্রে নীরব নির্বাক হইয়া সব দেখিল-বুক পাতিয়া নিদারুণ আঘাত গ্রহণ করিল।
বিলুর সৎকার যখন শেষ হইল তখন সূর্যোদয় হইতেছে। দেবু ঘরে প্রবেশ করিলনিঃস্ব, রিক্ত, তিক্ত জীবন লইয়া। সুখ-দুঃখের অনুভূতি মরিয়া গিয়াছে, হাসি ফুরাইয়াছে, অশ্রু শুকাইয়াছে, কথা হারাইয়াছে; মন অসাড়, দৃষ্টি শূন্য; ঠোঁট হইতে বুক পর্যন্ত নীরস শুষ্ক–সাহারার মত সব খাখা করিতেছে। দেওয়ালে ঠেস দিয়া সে উদাস শূন্য দৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে। চাহিয়া রহিল। সব আছে—সেই পথ, সেই ঘাট, সেই বাড়িঘর, সেই গাছপালা, কিন্তু দেবুর দৃষ্টির সম্মুখে সব অর্থহীন, সব অস্তিত্বশূন্য ঝাপসা, এক রিক্ত অসীম তৃষাতুর ধূসর প্রান্তর আর বেদনাবিধুর পাণ্ডুর আকাশ। ওই বিবর্ণ ধূসরতার মধ্যে ভবিষ্যৎ বিলুপ্ত নিশ্চিহ্ন।
সমস্ত গ্রামের লোকই ভিড় করিয়া আসিয়াছিল তাহাদের অকৃত্রিম সহানুভূতি জানাইতে। কিন্তু দেবুর এই মূর্তির সম্মুখে তাহারা কে কিছু বলতে পারিল না। যতীনও তাহাকে সান্ত্বনা দিতে আসিয়া নিৰ্বাক হইয়া বসিয়া ছিল। আত্মগ্লানিতে সে কষ্ট পাইতেছে—তাহার মনে হইতেছে দেবুকে সে-ই বোধহয় এই পরিণামের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে। জগনও স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। শ্ৰীহরি, হরিশ, ভবেশও আসিয়াছিল। তাহারাও নীরব। দেবুর সম্মুখে কথা বলিতে শ্ৰীহরিরও যেন কেমন সঙ্কোচ হইল।
ভবেশ শুধু বলিল হরি-হরি-হরি।
নির্বাক জনমণ্ডলীর প্রান্তদেশে দাঁড়াইয়া কে ডাকিল–ডাক্তারবাবু!
বিরক্ত হইয়া জগন বলিল—কে? কি?
–আজ্ঞে, আমি গোপেশ। একবার আসেন দয়া করে।
–কেন, হল কি?
দেবু একদিকের ঠোঁট বাঁকাইয়া বিষণ্ণ হাসিয়া বলিল—আর কি? বুঝতে পাচ্ছ না? যাও দেখে এস।
জগন দ্বিরুক্তি করিল না, উঠিয়া গেল। যতীন বলিল—দাঁড়ান, আমিও যাচ্ছি।
একে একে জনমণ্ডলী নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেল, দেবু একা ঘরে বসিয়া রহিল। এইবার তাহার ইচ্ছা হইল সে একবার বুক ফাটাইয়া কাঁদিবে। চেষ্টাও করিল, কিন্তু কান্না তাহার আসিল না। তারপর সে শুইবার চেষ্টা করিল। এতক্ষণে চারিদিক চাহিয়া চোখে পড়িল চারিদিকে শত সহস্ৰ স্মৃতি দেওয়ালে খোকার হাতের কালির দাগ, বিলুর হাতের সিঁদুরের চিহ্ন, পানের পিচ, খোকার রং-চটা কাঠের ঘোড়া, ভাঙা বাঁশি, ড়ো ছবি। পাশ ফিরিয়া শুইতে গিয়া শয্যাতলে যেন কিসের চাপে সে একটু বেদনা বোধ করিল। হাত দিয়া সেটা বাহির করিলখোকার বালা! সেই বালা দুই গাছি, বিলুর নাকছাবি, কানের ফুল, হাতের নোয়া। একটা পার-ফাটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে অকস্মাৎ ডাকিয়া উঠিল—খোকা! বিলু!
ঠিক এই সময়ে বাড়ির ভিতরের দিকের দরজার মুখে কে মুখ বাড়াইয়া বলিল, দেবু!
–কে? দেবু উঠিয়া আসিল–রাঙাদিদি?
বুড়ি হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। তাহার সঙ্গে আরও কেউ।
একা রাঙাদিদি নয়, দুৰ্গাও একপাশে বসিয়া নীরবে কাঁদিতেছিল।
দেবুর ইচ্ছা ছিল, গভীর রাত্রে—সকলে ঘুমাইলে—বিশ্বপ্রকৃতি নিস্তব্ধ হইলে সে একবার প্ৰাণ ভরিয়া কাঁদিবে।
একা নয়। সন্ধ্যা হইতে বহুজনেই আসিয়াছিল, সকলে চলিয়া গিয়াছে। তাহার নিকট শুইতে আসিয়াছে কেবল—জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল ও গাঁজাখোর গদাই, উচ্চিংড়ের বাবা তারিণী। শ্ৰীহরি ভূপাল চৌকিদারকেও পাঠাইয়াছে। সে রাত্রিতে দেবুর দাওয়ায় শুইয়া থাকিবে।
সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে দেবু উঠিল। উঠানে আসিয়া ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে চাহিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। খোকা নাই—বিলু নাই—বিশ্বসংসারে কোথাও নাই। স্বৰ্গ মিথ্যা, নরক মিথ্যা, পাপ মিথ্যা, পুণ্য মিথ্যা। কোন্ পাপ সে করিয়াছিল? পূর্বজন্মের? কে জানে? একবার যতীনের কাছে গেলে হয় না? একা বসিয়া সে খোকা ও বিলুকে চিন্তা করিবার অবসর খুঁজিয়াছিল, কিন্তু তাহাও যেন ভাল লাগিতেছে না। আত্মগ্লানিতেই তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সেই তো মৃত্যুর বিষ বহন করিয়া আনিয়াছিল। সে-ই তো তাহাদের হত্যা করিয়াছে। কোন্ লজ্জায় সে কাঁদিবে? সে বাহির হইয়া দাওয়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। দূরে রাস্তায় একটা আলো আসিতেছে।
এত রাত্রে আলো হাতে কে আসিতেছে? এক জন নয়, জনকয়েক লোকই আসিতেছে।