দেবু ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়াছে। টেলিগ্রাম লইয়া জংশনে গিয়াছে দুর্গা। ইউনিয়ন বোর্ডেও দেবু সংবাদ পাঠাইয়াছে, পাতু সেখানে গিয়াছে। নিজে সে রোগাক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়াছে। যাহারা গ্রাম হইতে সরিয়া যাইতে চাহিয়াছে—তাহাদিগকে সাহায্য করিয়াছে। তারপর উপেন বায়েনের সৎকারের ব্যবস্থা করিতে বসিয়াছে। বায়েনদের মধ্যে এখানে সক্ষম পুরুষ মাত্র তিন জন। তাহাদের এক জন পলাইয়াছে। বাকি দুই জন রাজি থাকিলেও দুই জনে একটা শব লইয়া যাওয়া অসম্ভব কথা। পাশেই বাউরিপাড়ায় অনেক লোক আছে। বটে, কিন্তু বাউরিরা মুচির শব স্পর্শ করিবে না। তবে বাউরিদের মাতব্বর সতীশ তাহার সঙ্গে আছে।
শ্মশানের পথও কম নয়, ময়ূরাক্ষীর গর্ভের উপর শ্মশান দূরত্ব দেড় মাইলের উপর। অনেক চিন্তা করিয়া শেষে বেলা এগারটার সময় আপনার গাড়ি গরু আনিয়া, দেবু গাড়িতে করিয়া উপেনের সকারের ব্যবস্থা করিল।
সৎকারের ব্যবস্থা করিয়াই তাহার কর্তব্য শেষ হইল না; বাউরিবায়েনদের দায়িত্বজ্ঞান কম হয়ত গ্রামের কাছেই কোথাও ফেলিয়া দিবে আশঙ্কা করিয়া সে শবের সঙ্গে শ্মশান পর্যন্ত যাইতে প্রস্তুত হইল। তা ছাড়া পাতুও তাহার সঙ্গী—মাত্র দুই জনে এই কলেরারোগীর মৃতদেহ লইয়া শ্মশানে যাইতে তাহারা যেন ভয় পাইতেছিল। দেবু তাহা অনুভব করিল। এবং বলিল–ভয় করছে পাতু?
শুকমুখে পাতু বলিল–আজ্ঞে?
–ভয় করছে নিয়ে যেতে?
–করছে একটুকু। ভয়ার্ত শিশুর মতই অপকটে সে স্বীকার করিল।
–তবে চল, আমি তোমাদের সঙ্গে যাই।
–আপুনি?
–হ্যাঁ, আমি। চল যাই।
পাতু ও তাহার সঙ্গীর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। পাতু বলিল—আপুনি বাঁধের ওপরটিতে শুধু দাঁড়াবেন তা হলেই হবে।
–চল, আমি শ্মশান পর্যন্তই যাব।
প্রচণ্ড উত্তাপে উত্তপ্ত বৈশাখী দ্বিপ্রহরে তাহারা গাড়ির উপর শবদেহ চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িল। মাঠ আজ জনশূন্য। রাখালেরা সকলেই প্ৰায় এই বাউরিবায়েনের ছেলে—তাহারা এমন আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছে যে, মাঠে গরু লইয়া আসে নাই। গ্রামের আশপাশেই গরু লইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বৈশাখী দ্বিপ্রহরে এই ধু-ধু করা প্রান্তরে আসিয়া যদি অকস্মাৎ তাহারা রোগাক্রান্ত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে কি হইবে? মাঠে আগুনের মত ধুলায় পড়িয়া তৃষ্ণায় ছটফট করিয়া মরিবে যে! এই আতঙ্কে তাহারা আতঙ্কিত। চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মাঠখানা খাখা করিতেছে। মধ্যে যে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, তাহার আর এক বিন্দুও কোথাও জমিয়া নাই। মাটির রস পর্যন্ত শুকাইয়া গিয়াছে। প্রাচীন কালের বড় বড় সিচের পুকুরগুলি এমনভাবে মজিয়া গিয়াছে, মোহনার বাঁধ এমনভাবে ভাঙিয়া গিয়াছে যে, বিন্দু বিন্দু করিয়া যে জল ভিতরে জমে, তাহাও নিঃশেষে বাহির হইয়া আসে। গ্রামের প্রান্ত হইতে ময়ূরাক্ষী পর্যন্ত কোথাও এক ফোঁটা জল নাই। ঝড়ের মত প্রবল বৈশাখী দ্বিপ্রহরের বাতাসে মাঠের ধুলা উড়িতেছে; তাহাতে যেন আগুনের স্পৰ্শ। ইহারই মধ্যে গাড়িটা ধীর গতিতে চলিয়াছিল। ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ -চাকার দীর্ঘ একটানা একঘেয়ে শব্দ উঠিতেছে। ক্যাঁ-ক্যাঁ–
পাতু বলিল—এবার আর আমাদের রক্ষে নাই; কেউ বাঁচবে না পণ্ডিত মশায়।
দেবু স্নেহসিক্ত স্বরে অভয় দিয়া বলিল–তুই পাগল পাতু! ভয় কি?
–ভয়? পাতু হাসিল, বলিল—একেবারে পয়লা বোশেখ নামুনে ঢুকল গাঁয়ে। তা ছাড়া লোকে বলছে—এবার আমরা চণ্ডীমণ্ডপ ছাইয়ে দিলাম না-বাবা বুড়োশিবের রাগেই হয়ত–
দেবুও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। সে দেবধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু বাবা কি এমনই অবিচার করিবেন? নিরপরাধের অপরাধটাই বড় হইবে তাঁহার কাছে? দেবোত্তর সম্পত্তি যাহারা আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছে, তাহাদের তো কিছু হয় নাই? সে দৃঢ়স্বরে বলিলনা পাতু, বাবার কাছে। কোনো অপরাধ তোমাদের হয় নাই। আমি বলছি।
পাতু বলিল—তবে ইরকমটা ক্যানে হল পণ্ডিত মশাই?
দেবু কলেরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আরম্ভ করিল।
উঃ! এই ঠিক দুপুরে স্ত্রীলোক কে এদিকে আসিতেছে? বোধ হয় জংশন হইতে ফিরিতেছে। হ্যাঁ, তাই তো। এ যে দুৰ্গা! দুৰ্গা টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়া ফিরিতেছে।
উপেনের শবের সঙ্গে দেবুকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল—নিকটে আসিয়া তিরস্কার-ভরা কণ্ঠ করিয়া বলিল—এ কি করেছ জামাই! তুমি কেন এলে? তুমি যাচ্ছ কেন? ফের!
দেবু কথাটা একেবারে ঘুরাইয়া দিল—এতক্ষণে ফিরলে দুর্গা! টেলিগ্ৰাম হল?
–হল। কিন্তু তুমি কিসের লেগে যাচ্ছ জামাই? ফিরে চল!
–ফিরছি, তুই যেতে লাগ।
–না, তুমি ফের আগে!
–পাগলামি করিস না দুর্গা। তুই যা, আমি শিগগির ফিরব।
তাহারা চলিয়া গেল; দুর্গার চোখ দিয়া অকারণে জল পড়িতে আরম্ভ করিল।
শীঘ্ৰ ফিরিব বলিলেও শীঘ্ৰ ফেরা হইল না। ফিরিতে অপরাত্ন গড়াইয়া গেল। ময়ূরাক্ষীর কাদা-বালি-গোলা, হাঁটুডোবা জলে কোনোমতে স্নান সারিয়া বাড়ি আসিয়া দেবু ডাকিল–বিলু!
ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল খোকা, তাহার খোকনমণি। দুটি হাত বাড়াইয়া সে ডাকিল–বা-বা!
দেবু দুই পা পিছনে সরিয়া আসিয়া বলিল–না, না, ছুঁয়ো না আমাকে। না।
খোকন আমোদ পাইয়া গেল। মুহূর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল লুকোচুরি খেলার আমোদ, সে খিলখিল করিয়া হাত বাড়াইয়া আরও ছুটিয়া আসিল। খোকনের আমোদের ছোঁয়াচ দেবুকেও লাগিল—সে আরও খানিকটা সরিয়া আসিয়া বলিল না খোকন, দাঁড়াও ওখানে। তারপর সে ডাকিল বিলুকে।—বিলু–বিলু!