প্রৌঢ় প্রবীণ ধর্মপরায়ণ চৌধুরী বলিয়া উঠিল—রাম! রাম! রাম! রাধাকৃষ্ণ! রাধাকৃষ্ণ!
পাতু বলিল–আজ্ঞে রাম রাম লয়, চৌধুরী মশায়। আমার ভগ্নী দুর্গা একটু বজ্জাত বটে; বিয়ে দেলাম তো পালিয়ে এল শ্বশুরঘর থেকে। সেই তারই সঙ্গে মশায় ছিরু পাল ফষ্টিনষ্টি করবে। যখন তখন পাড়ায় এসে ছুতোনাতা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে বসবে। আমার মা হারামজাদীকে তো জানেন? চিরকাল একভাবে গেল; ছিরু পালকে বসতে মোড়া দেবেতার সঙ্গে ফুসফাস করবে। ঘরে মশায়, আমার বউ রয়েছে। তাকে, মাকে আর দুর্গাকে আমি ঘা-কতক করে দিয়েছিলাম। মোড়লকেও বলেছিলাম, ভাল করেই বলেছিলাম চৌধুরী মশাই,–আমাদের জাতজ্ঞেতে নিন্দে করে—আর আপনি আসবেন না মশায়। এ আক্কোশটাও আছে মশাই।
লাঠি ও ছাতায় চৌধুরীর দুই হাত ছিল আবদ্ধ, কানে আঙুল দিবার উপায় ছিল না; সে ঘৃণাভরে থুতু ফেলিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিলরাধাকৃষ্ণ হে! থাক পাতু, থাক বাবা-সক্কালবেলা ওসব কথা আমাকে আর শুনিও না। এতে আর আমার কি হাত আছে বল? রাধাকৃষ্ণ!
পাতু কিন্তু ইহাতে তুষ্ট হইল না। সে কোনো কথা না বলিয়া চৌধুরীকে পাশ কাটাইয়া। হনহন করিয়া অগ্রসর হইল। তাহার পিছন পিছন তাহার স্ত্রী আবার ছুটিতে আরম্ভ করিল–স্বামীর নীরবতার সুযোগ পাইয়া সে আবার কান্নার সুরে সুর করিল-হারামজাদী আবার ঢং করে। ভাইয়ের দুঃখে ঘটা করে কানতে বসেছে গো! ওগো আমি কি করব গো!
পাতু বিদ্যুৎগতিতে ফিরিল; সঙ্গে সঙ্গে বউটি আতঙ্কে অস্ফুট চিৎকার করিয়া উঠিল—অ্যাঁ—
পাতু মুখ খিঁচাইয়া বলিল—চেন্নাস না বাপু। তোকে কিছু বলি নাই… তু থাম। ধাক্কা দিয়া স্ত্রীকে সরাইয়া দিয়া সে ফিরিয়া পশ্চাদগামী চৌধুরীর সম্মুখে আসিয়া বলিল-আচ্ছা চৌধুরীমশায়, আলিপুরের রহমৎ শাঁখ যে কঙ্কণার রমন্দ চাটুজ্জের সঙ্গে ভাগাড় দখল করেছে, তার কি করছেন।
আশ্চর্য হইয়া চৌধুরী বলিলেন–সে কি!
–আজ্ঞে হ্যাঁ মশায়। ভাগাড়ের চামড়া দিগে ছাড়া আর কাউকে বেচতে পাব না। আমরা। তারা বলে, ভাগাড় জমিদার আমাদিগে বন্দোবস্ত দিয়েছে। ছাল ছাড়ানোর মজুরি আর নুনের দাম তার ওপর দু-চার আনা ছাড়া আর কিছু দেয় না। অথচ চামড়ার দাম এখন আগুন।
তা হলে?
চৌধুরী পাতুর মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল—সত্যি কথা পাতু?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। মিছে যদি হয় পঞ্চাশ জুতো খাব, নাকে খৎ দোব।
—তা হলে, চৌধুরী ঘাড় নাড়িয়া বলিলতা হলে হাজার বার তুমি বলতে পার ও-কথা, গায়ের লোক পয়সা দিতে বাধ্য; কিন্তু জমিদারের গোমস্তা নন্দীকে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছ?
পাতু বলিল-গোমস্তা নন্দী কেন, জমিদারের কাছেই যাব আমি। ডাক্তার ঘোষ মশায়। বললে, থানায় যা। তা থানা কেন আগে জমিদারের কাছেই যাই, দুটো বিচারই হয়ে যাক। দেখি জমিদার কি বলে!
সে আবার ফিরিল এবং সোজা আলপথটা ছাড়িয়া দক্ষিণ দিকের একটা আল ধরিয়া কঙ্কণার দিকে মুখ করিল। বৃদ্ধ চৌধুরী টুকটুক করিয়া নদীর চরের দিকে অগ্রসর হইল। নদীর ওপারের জংশনের কলগুলার চিমনি এইবার স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আর চৌধুরী চরের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু হতভম্ব হইয়া গিয়াছে বৃদ্ধ চৌধুরী; সব করিয়া সব হইল—শেষে চামড়া বেচিয়া রামেন্দ্র চাটুজ্জে বড়লোক হইবে! ছিঃ ছিঃ, ব্রাহ্মণের ছেলে।
০৫. যমজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে
গল্পে শোনা যায়, যমজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে যমদূতেরা রামের বদলে শ্যামকে লইয়া যায়, শ্যামের বদলে আসিয়া ধরে রামকে। তাদের অনুকরণে হইলেও ক্ষেত্র বিস্মৃততর করিয়া লইয়া রাম অপরাধ করিলে মানুষ অতিবুদ্ধিবশত প্রায়ই শ্যামকে লইয়া টানাটানি করে। পুলিশও মানুষ, সুতরাং এক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হইল না। পরদিনই একটা পুলিশ তদন্ত হইয়া গেল। অনিরুদ্ধ আক্ৰোশের কারণ দেখাইয়া ছিরু পালকে সন্দেহ করিলেও পুলিশ আসিয়া মাঠআগলদার সতীশ বাউরির বাড়ি খানাতল্লাশ করিয়া সব তছনছ করিয়া তাহাকে টানিয়া আনিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকটাকে জেরায় নাজেহাল করিয়া অবশেষে ছাড়িয়া দিল। অবশ্য অনিরুদ্ধের সন্দেহ অনুযায়ী একবার ছিরু পালের খামার-বাড়িটাও ঘুরিয়া দেখিল, কিন্তু সেখানে দুই বিঘা জমির আধ-পাকা ধানের একগাছি খড়ও কোথাও মিলিল না।
পুলিশ আসিয়া গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপেই বসিয়াছিল। গ্রামের মণ্ডল-মাতব্বরেরাও আসিয়া চন্দ্ৰমণ্ডলের নক্ষত্র সভাসদের মত চারিপাশে জমকাইয়া বসিয়া উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করিয়া পরস্পরের মধ্যে কথা বলিতেছিল। ছিরু পাল বসিয়াছিল পুলিশের অতি নিকটেই এবং অত্যন্ত গম্ভীরভাবে। তাহার আকৰ্ণবিস্তৃত মুখগহ্বরের পাশে চোয়ালের হাড় দুইটা কঠিন ভঙ্গিতে উঁচু হইয়া উঠিয়াছিল। অনিরুদ্ধ সম্মুখেই উবু হইয়া বসিয়া মাটির দিকে চাহিয়া কত কি ভাবিতেছিল। তদন্ত-শেষে পুলিশ উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধও উঠিল। সে চাহিয়া না দেখিয়াও স্পষ্ট অনুভব করিতেছিল যে, সমস্ত গ্রামের লোক কঠিন প্রতিহিংসা-তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। প্রত্যক্ষ যন্ত্ৰণা সহ্য করা যায়–নিরুপায় হইয়া মানুষকে সহ্যও করিতে হয়, কিন্তু যন্ত্রণারও ভাবী ইঙ্গিত বা নিষ্ঠুর কল্পনা মানুষের পক্ষে অসহ্য। সে পুলিশেরই পিছন পিছন উঠিয়া আসিল।
পুলিশ চলিয়া যাইতেই চণ্ডীমণ্ডপে প্রচণ্ড কলরব উঠিল। সমবেত জনতার প্রত্যেকে আপন আপন মন্তব্য ঘোষণা আরম্ভ করিল; কেউ কাহারও কথা শোনে না দেখিয়া প্রত্যেকেই আপন আপন কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব উচ্চগ্রামে লইয়া গেল। সদ্গোপ সম্প্রদায়ের কেহই অবশ্য শ্ৰীহরি ঘোষকে সুনজরে দেখে না; কিন্তু অনিরুদ্ধ কৰ্মকার যখন পুলিশে খবর দিয়া তাহার বাড়ি খানাতল্লাশ করাইল, বাড়িতে পুলিশ ঢুকাইয়া দিল, তখন অপমানটাকে তাহারা সম্প্রদায়গত করিয়া লইয়া বেশ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। বিশেষ করিয়া সেদিন অনিরুদ্ধের সমাজকে উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্যজনিত অপরাধের ভিত্তির উপর আজিকার ঘটনাটা ঘটিবার ফলে বিষয়টা গুরুত্বে রীতিমত বড় হইয়া উঠিয়াছে।