শ্ৰীহরির খিড়কির ঘাটে শ্রীহরির মা উচ্চকণ্ঠে সবিস্তারে অনিরুদ্ধের শাস্তির কথা। দম্ভ-সহকারে ঘোষণা করিতেছে। এ সে বহুক্ষণ পূর্বেই আরম্ভ করিয়াছে, এখনও শেষ হয় নাই। পুত্ৰগৰ্বিতা বৃদ্ধা শুধু অপেক্ষা করিতেছে—অদূরে উচ্চকণ্ঠের একটি সবিলাপ রোদন-ধ্বনির।
কথাবার্তা কহিবার অবসর আজ খুব কমই হইতেছিল।
চা খাওয়া শেষ করিয়া যতীন বলিল চৌধুরী কেমন আছেন ডাক্তারবাবু?
দেবু চমকাইয়া উঠিল, অনিরুদ্ধের হাঙ্গামায় আজ দুদিন চৌধুরীর সংবাদ লওয়াই হয় নাই!
জগন বলিল—একটু ভাল আছেন। তবে এই একটুকু ঘা আর কিছুতেই সারছে না। ঘায়ের মুখ থেকে অল্প অল্প পুঁজ পড়ছে, আর প্রায়ই সামান্য সামান্য জ্বর হচ্ছে।
যতীন বলিল—যাব একদিন দেখতে।
দেবু বলিল-কালই চলুন না সকালে। আমি যাব।
—আমাকে ডেকো দেবু। তোমাদেরই সঙ্গে যাব। আমাকে তো যেতেই হবে, একসঙ্গেই যাব। হরেন যাবে নাকি?
–টুমরো তো হবে না ব্রাদার! পয়লা বোশেখ খাতা ফেরার হাঙ্গামা আছে। আমাকে ছুটতে হবে আলেপুর, ইছু শেখের কাছে—গোটাচারেক টাকা আনতে হবে। নইলে বেটা বৃন্দাবনকে তো জানঃ একটি পয়সা আর ধার দেবে না।
পয়লা বৈশাখ হালখাতা। কথাটা যেন ঝনাৎ করিয়া পড়িল। কথাটা দেবুরও মনে হইল। ধার সে বড় করে না। তবে এবার তাহার অনুপস্থিতিতে দুর্গার মারফত জংশনের একটা দোকানে বাকি পড়িয়াছে এগার টাকা দশ আনা। অনিরুদ্ধের হাঙ্গামায় কথাটা তাহার মনেই হয় নাই। দুৰ্গাও কোনো তাগাদা দেয় নাই। টাকাটা বা কোথা হইতে আসিবে? আসিয়া অবধি নিজের ভাবনা যে ভাবাই হয় নাই। কিন্তু না ভাবিলে ভবিষ্যৎ কি হইবে?
সে যদি হঠাৎ মারা যায়, তবে কি বিলু এই পদ্মের মত—কিংবা অবশেষে তারিণীর স্ত্রীর মতভাবিতেই সে শিহরিয়া উঠিল। বার বার সে নিজেকে ধিক্কার দিয়া উঠিল—ছি, ছি, ছি!
তবুও চিন্তা গেল না। বিলুর বদলে মনে হইল খোকার কথা।
তাহার খোকাও কি ওই উচ্চিংড়ের মত না-না—না। সে মনে মনেই বলিল—কিছুতেই না। কাল নববর্ষের প্রথম দিন হইতে সে নিজের ভাবনা ভাবিবে, আর নয়—আর নয়। স্ত্রী-পুত্র লইয়া—দারিদ্য লইয়া দশের ভাবনা ভাবিবার অধিকার তাহার নাই, সে অধিকার ভগবান তাহাকে দেন নাই। সে ভার—সে অধিকার শ্ৰীহরির। গোটা গাজনের খরচটা সে-ই দিয়াছে। গোটা দেশের লোককে ধান দাদন সে-ই দিয়াছে; সে ভার তাহার।
সে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে উঠিয়া পড়িল।
জগন জিজ্ঞাসা করিলকি ব্যাপার হে? হঠাৎ উঠলে?
–একটা জরুরি কাজ ভুলেছি।
সে চলিয়া আসিল। পথে চণ্ডীমণ্ডপে উঠিয়া শিবকে প্রণাম করিল—হে দেবাদিদেব মহাদেব, ভালয়-ভালয় এ বৎসর পার করে দিলে। আশীর্বাদ কর–আগামী বৎসরটি যেন ভালয়-ভালয় যায়।
খোঁড়া পুরোহিত তাহাকে আশীর্বাদী নিৰ্মাল্য দিল।
***
পথে নামিয়া সে বাড়ি গেল না। সে গেল দুর্গার বাড়ি। দুর্গাই দোকান হইতে ধার আনিয়া দিয়াছিল। তাহারই মারফতে একটা টাকা কাল সে পাঠাইয়া দিবে এবং মাসখানেক সময় চাহিয়া লইবে। সময় একটু বেশি লওয়াই ভাল। বৈশাখের প্রথমেই সে তিসি, মসিনা, গম, যবযে কয়টা ঘরে আছে বিক্রি করিয়া দিবে। সর্বাগ্রে সে ঋণ পরিশোধ করিবে।
বাড়িতে দুর্গার মা বসিয়া ছিল; একা অন্ধকারে দাওয়ার উপর বসিয়া কাহাকে গালি দিতেছিল রাক্ষস, প্যাটে আগুন নাগুক আগুন নাগুক আগুন নাক! মরুক, মরুক, মরুক। আর হারামজাদী, নচ্ছারী, বানের আগে কুটো, সব্বাগ্যে তোর যাওয়ার কি দরকার শুনি?
দেবু জিজ্ঞাসা করিল-ও পিসেস, দুর্গা কই?
বিলু দুর্গার মাকে বাপের বাড়ির গ্রামবাসিনী হিসাবে পিসি বলে, তাই দেবু বলে পিসেস। অর্থাৎ পিস-শাশুড়ি।
দুর্গার মা মাথায় একটু ঘোমটা টানিয়া দিল। জামাইয়ের সামনে মাথায় কাপড় না থাকিলে, এবং জামাই মাথার চুল দেখিলে, চিতায় নাকি মাথার চুল পোড়ে না। ঘোমটা দিয়া দুর্গার মা বলিল—সে নচ্ছারীর কথা আর বোলো না বাবা! বানের আগে কুটো! রূপেন বায়েনের কি না। কি ব্যামো হয়েছে, তাই সৰ্বাগ্যে গিয়েছেন তিনি।
রূপেন অর্থাৎ উপেন। আত্মীয়স্বজনহীন বৃদ্ধ উপেন, আহা-হা বেচারি! কেউ নাই সংসারে। কিন্তু সে তো এখানে থাকে না। সে তো কঙ্কণায় ভিক্ষা করিত।
দেবু প্রশ্ন করিল—উপেন আজকাল গায়ে ফিরেছে নাকি?
—মরতে ফিরেছে বাবা। গায়ে আগুন নাগাতে ফিরেছে। কাল থেকে গায়ে গাজনের মেলা দেখতে এসেছে। আজ সকালে ফুলুরীর দোকানদার কতকগুলো তে-বাসী ফুলুরী ফেলে দিয়েছিল—সেনেটারি বাবু আসবে শুনে। রূপেন তাই কুড়িয়ে গবাগব খেয়েছে। খেয়ে সনঝে থেকে নামুনে হয়েছে। আমাদের দুগ্গা বিবি তাই শুনে দেখতে ছুটেছেন। আহা-হ্যাঁ, দরদ কত! কি বলব বাবা বল?
নামুনে অর্থাৎ কলেরা। সর্বনাশ! সম্মুখে এই বৈশাখ মাসকোথাও এক ফোঁটা পানীয় জল নাই, এই সময় কলেরা!
সে দ্রুতপদে আসিয়া উঠিল উপেনের বাড়ি। এক মুহূর্তে তাহার সব ভুল হইয়া গেল।
উঠানে মাটির উপর পড়িয়া জরাজীর্ণ বৃদ্ধ ছটফট করিতেছিল, জ-ল-জ-ল-জ-ল! স্বর অনুনাসিক হইয়া উঠিয়াছে। অন্য কেহ নাই, কেবল দুর্গা দাঁড়াইয়া আছে, সে যথাসাধ্য সংস্পর্শ বাঁচাইয়া একটা ভাঁড়ে করিয়া তাহাকে জল ঢালিয়া দিয়াছে। বৃদ্ধ কিন্তু আপনার জল খাইবার ভড়ের নিকট হইতে অনেকটা দূরে আসিয়া নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে। কম্পিত বাহু বিস্তার করিয়া বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তীব্ৰ ব্যগ্রতায় সে চিৎকার করিতেছে–জল—একটু জল।