চাট ছুড়বে।
—তোর মাথা। পেছনকার একটা ঠ্যাং খোঁড়া। চাঁট ছুড়তে গেলে নিজেই ধপাস করে পড়ে যাবে। ধ। ওইটার উপর চেপে দুজনা চলে যাব। তোর কাপড়টা খোল, নাগাম করব।
সত্যই ঘোড়াটা চাঁট ছুড়িতে পারে না; কিন্তু কামড়ায়, খেঁকি কুকুরের মত দাঁত বাহির করিয়া মাথা উঁচাইয়া কামড়াইতে আসে। এটা উচ্চিংড়ে জানি না। সম্ভবত এটা ঘোড়াটার আত্মরক্ষার আধুনিকতম অস্ত্র আবিষ্কার। অশ্বারোহণের সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে হইল।
****
সন্ধ্যায় গাজনের পূজা শেষ। চড়ক শেষ হইয়াছে। ভক্তদের আগুন লইয়া ফুল-খেলাও হইয়া গিয়াছে। বলি হোমও হইয়া গিয়াছে। কপালে তিলক পরিয়া ভবেশ ও হরিশ চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া আছে। শ্ৰীহরি এখনও সদর হইতে ফেরে নাই। ঢাকীর দল প্রচণ্ড উৎসাহে ঢাকের বাজনার কেরামতি দেখাইতেছে। বড় বড় ঢাক, ঢাকের মাথায় দেড়হাত লম্বা পালকের ফুল। এ ঢাকের আওয়াজ প্রচণ্ড, ভদ্রলোকেরা বলে, ঢাকের বাদ্য থামিলেই মিষ্টি লাগে। কিন্তু ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজ নিপুণ বাদ্যকরের হাতে রাগিণীর উপযুক্ত বোলে যখন বাজে, তখন আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হইয়া যায়—গুরুগম্ভীর ধ্বনির আঘাতে মানুষের বুকের ভিতরেও গুরুগম্ভীর ঝঙ্কার উঠে। নাচিয়া নাচিয়া নানা ভঙ্গি করিয়া মুখে বোল আওড়াইয়া এক একজন ঢাকী পর্যায়ক্রমে ঢাক বাজাইতেছে, তাহাদের নাচের সঙ্গে নাচিতেছে-কাকের পাখার কালো পালকের তৈয়ারি ফুল; একেবারে মাথার কাছে বকের সাদা পালকের গুচ্ছ।
হরিশ আক্ষেপ করিতেছিল—এবার চৌধুরী আসতে পারলেন না, ঠাঁইটি একেবারে খা খ করছে।
চৌধুরী প্রতি বৎসর উপস্থিত থাকে। ঢাকের বাজনার সে একজন সমঝদার শ্রোতা। বসিয়া বসিয়া তালে তালে ঘাড় নাড়ে। পাশে থাকে একটি পোটলা। বাজনার শেষে চৌধুরী পোটলা খুলিয়া পুরস্কার দেয়-কাহাকেও পুরনো জামা, কাহাকেও পুরনো চাদর, কাহাকেও বা পুরনো কাপড়। এবার চৌধুরী শয্যাশায়ী হইয়া আছে। সেই মাথায় আঘাত পাইয়া বিছানায় শুইয়াছে, আর ওঠে নাই। ঘা শুকাইতেছে না, সঙ্গে সঙ্গে অল্প অল্প জ্বরও হইতেছে।
চণ্ডীমণ্ডপের চারিপাশে মেলার মধ্যে পথে ভিড় এখন প্রচুর। মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী, পুরুষ দলে দলে ঘুরিতেছে। সন্ধ্যার পর কবিগান হইবে। কলরবের অন্ত নাই। অকস্মাৎ সেই কলরব ছাপাইয়া কালু শেখের গলা শোনা গেলহঠ হঠ, হঠ সব!
ভিড় ঠেলিয়া পথ করিয়া কালু শেখ বাহির হইয়া আসিল—তাহার পিছনে শ্ৰীহরি। ঘোষ ফিরিয়াছে। ভবেশ ও হরিশ অগ্রসর হইয়া গেল।
শ্ৰীহরি ফোকলাদাঁতে একগাল হাসিয়া বলিল—সুখবর! দুই মাস সশ্রম কারাদণ্ড।
***
পথের ভিড় ঠেলিয়া দেবু ঘোষও যাইতেছিল। বিমর্ষমুখে সে গেল যতীনের ওখানে।
যতীন, দেবু, জগন ও হরেন—আজ সান্ধ্য মজলিসে লোক কেবল চার জন। সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছে। আজিকার সমস্যা-পদ্মকে এ সংবাদটা কে দিবে, কেমন করিয়া দিবে?
ভিতরের দরজায় শিকল নড়িয়া উঠিল। পদ্ম ডাকিতেছে। যতীন উঠিয়া গেল। অনিরুদ্ধের দণ্ডের কথা শুনিয়া যতীন খুব বিষ হয় নাই। দুই মাস জেল যতীনের মতে লঘুদণ্ডই হইয়াছে। যে মন লইয়া অনিরুদ্ধ দেবুকে মিথ্যা দণ্ড হইতে বাঁচাইতে গিয়া সত্য স্বীকারোক্তি করিয়াছে, সে মন যদি তাহার টিকে—তবে সে নূতন মানুষ হইয়া ফিরিবে। আর যদি সে মন বুদ্বুদের মত ক্ষণস্থায়ীই হয়—তবুও বা দুঃখ কিসের! দারিদ্র-ব্যাধিতে জীর্ণ মনুষ্যত্বের মৃত্যু তো ধ্রুবই ছিল। কিন্তু বিপদ হইয়াছে পদ্মকে লইয়া। কি মায়ায় যে এই অশিক্ষিতা আবেগ-সর্ব পল্লীবধুটি তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছে তাহা সে বুঝিতে পারে না। বুদ্ধি দিয়া বিশ্লেষণ করিয়াও সে তাহাকে উপেক্ষা করিতে পারে না। বৃহত্তর জীবন, মহত্তর স্বার্থের মানদণ্ডে ওজন করিয়াও সে কিছুতেই তাহার মূল্যকে অকিঞ্চিৎকর করিয়া তুলিতে পারে না। মাটির মূর্তির মধ্যে সে দেবীরূপ কল্পনা করিতে পারে না। জলে বিসর্জন দিলে সে মূর্তি গলিয়া কাদা হইয়া যায়, জলতলে সে রূপ পঙ্কসমাধি লাভ করে, এ সত্য মনে করিয়া সে হাসে। কিন্তু ঐ ভঙ্গুর মাটির মূর্তি অক্ষয় দেবীরূপ লাভ করিল কেমন করিয়া? কালের নদী-জলে তাহাকে বিসর্জন দিলেও যে সে গলিবে না বলিয়া মনে হইতেছে। শিক্ষা নাই সংস্কৃতি নাই, অভিমান ও কুসংস্কার সর্বস্ব পদ্ম মাটির মূর্তি ছাড়া আর কি? সে এমন সজীব দেবীমূর্তি হইয়া উঠিল কি করিয়া? কোন্ মন্ত্রে?
ইতিমধ্যে কাঁদিয়া কাঁদিয়া পদ্মের চোখ দুইটা ফুলিয়া উঠিয়াছে। চোখের জল মুছিতে মুছিতে ম্লান হাসিয়া সে বলিল-দু মাস জেল হয়েছে?
যতীন আশ্চর্য হইয়া গেল। ইহার মধ্যে কথাটা তাহাকে কে বলিল? মাথা নিচু করিয়া সে বলিল–হ্যাঁ।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল পদ্ম, বলিলতা হোক। ভালয় ভালয় ফিরে আসুক সে। কিন্তু পণ্ডিতকে যে তার পাপের দণ্ডভোগ করতে হয় নাই, সে যে সত্যি কথা বলেছে—সেই আমার ভাগ্যি। তা না হলে তার অনন্ত নরক হত, সাত পুরুষ নরকস্থ হত।
যতীন অবাক হইয়া গেল।
পদ্ম বলিল জল গরম হয়েছে, চা তুমি করে নাও। আমি একবার দেখি সেই মুখপোড়া ছেলে দুটোকে। এখনও ফেরে নাই। সারাদিন খায় নাই।
—তুমিও তো খাও নি মা-মণি? খেয়ে নাও। যতীনের মনে পড়িল—কাল পদ্মের নীলষষ্ঠীর উপবাস গিয়াছে। আজ আবার সে সারাদিন গাজনের উপবাস করিয়াছে।
—খাব। সে দুটোকে আগে ধরে আনি।
যতীন আর কিছু বলিবার পূর্বেই পদ্ম বাহির হইয়া গেল।