কালু শেখ আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল—হজুরের মা ডাকিতেছে।
–মা? ও, আজ যে আবার নীলষষ্ঠী! শ্ৰীহরি উঠিয়া বাড়ির ভিতরে গেল।
চৈত্র-সংক্রান্তির পূর্বদিন নীল-ষষ্ঠী। তিথিতে ষষ্ঠী না হইলেও মেয়েদের যাদের নীলের মানত আছে, তাহারা ষষ্ঠীর উপবাস করিবে, পূজা করিবে, সন্তানের কপালে ফোঁটা দিবে। নীল অর্থাৎ নীলকণ্ঠ এই দিনে নাকি লীলাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। লীলাবতীর কোল আলো করিয়া নীলমণির শোভা। নীলষষ্ঠী করিলে নীলমণির মত সন্তান হয়।
পদ্ম সকল ষষ্ঠীই পালন করে; সে-ও উপবাস করিয়া আছে। কিন্তু বিপদ হইয়াছে উচ্চিংড়ে ও গোবরাকে লইয়া। আজ সকালবেলা হইতেই তাহাদের দেখা নাই। চড়ক-পাটা বাহির হইয়াছে। ঢাক বাজাইয়া ভক্তরা গ্রামে গ্রামে ফিরিতেছে। একটা লোহার কাটায় কণ্টকিত তক্তার উপর একজন ভক্ত শুইয়া থাকিবে। সে কি সোজা কথা! সেই বিস্ময়কর ব্যাপারের পিছনে পিছনে তাহারা ফিরিতেছে। আগে এখানে বাণ ফেঁড়া হইত, এখন আর হয় না।
পদ্ম অপেক্ষা করিয়া অবশেষে নিজেই চণ্ডীমণ্ডপের প্রান্তে আসিয়া পাঁড়াইল। চণ্ডীমণ্ডপে ঢাক বাজিতেছে। বোধ হয় এ বেলার মত চড়ক ফিরিয়া আসিল।
চণ্ডীমণ্ডপ ঘিরিয়া মেলা বসিয়াছে। খানবিশেক দোকান। তেলেভাজা মিষ্টির দোকানই বেশি। বেগুনি, ফুলুরী, পাপড়-ভাজা হইতেছে। ছেলেরা দলে দলে আসিয়া কিনিয়া খাইতেছে। খানচারেক মনিহারি দোকান। সেখানে তরুণী মেয়েদেরই ভিড় বেশি-ফিতা, টিপ, আলতা, গন্ধ কিনিতেছে। গাছতলায় ছোট আসর পাতিয়া বসিয়াছে তিনজন চুড়িওয়ালী। একটা গাছতলায় বৈরাগীদের নেলোও বসিয়াছে কতকগুলা মাটির পুতুল লইয়া। ওমা, বুড়ো পুতুলগুলো তো বেশ গড়িয়াছে! উঁকা হাতে তামাক খাইতেছে—আবার ঘাড় নাড়িতেছে! বয়স্কেরা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—অলস পদক্ষেপে। আজ কাল দুই দিন কোনো চাষের কাজ নাই। হাল চষিতে নাই, গরু জুতিতে নাই। এই দুই দিন সর্বকর্মের বিশ্রাম।
উচ্চিংড়ে ও গোবরার সন্ধান মিলিল না। তাহা হইলে চড়ক হইতে এখনও ফেরে নাই! ও ঢাক শ্ৰীহরি ঘোষের ষষ্ঠী-পূজার ঢাক। পদ্ম বোধহয় জানে না—ঘোষ এবার দশখানা ঢাকের বন্দোবস্ত করিয়াছে।
পাতু নিজের গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে বাজাইতে গিয়াছে। সর্বত্রই এক অবস্থা। বাদ্যকরের চাকরান জমি প্রায় সর্বত্রই উচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে। এ গ্রামের ঢাকী ও গ্রামে যায়, সে গ্রামের ঢাকী আসিয়াছে এ গ্রামে। সতীশ বাউরিও তাহার বোলানের দল লইয়া অন্য গ্রামে গিয়াছে।
অগত্যা পদ্ম বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া মাটিতে আঁচল বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। পরের সন্তান। লইয়া এ কি বিড়ম্বনা তাহার! কিছুক্ষণ পর আবার সে বাহির হইল। এবার শুষ্ক মুখ, ধূলিধূসরদেহ ছেলে দুইটাকে দেখিতে পাইয়া তাহাদিগকে ধরিয়া যতীনের সম্মুখে আনিয়া বলিল—এই দেখ, একবার ছেলে দুটোর দশা দেখ! তুমি শাসন কর!
যতীন কিছু বলিল না, মৃদু হাসিল।
পদ্ম বলিল—হেসো না তুমি। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় তোমার হাসি দেখলে। ভেতরে এস একবার, ফোঁটা দেব।
ফোঁটা দিয়া পদ্ম বলিল হাসি নয়, উচ্চিংড়েকে তুমি বল, এমনি করে বাইরে বাইরে ফিরলে তুমি ওকে রাখবেই না এখানে, জবাব দেবে। খেতে দেবে না। গোবরাটা ভাল—ওকে নিয়ে যায় উচ্চিংড়েই। কাল ওরা যেন না বেরোয় ঘর থেকে।
যতীন এবার মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টানিয়া আনিয়া বলিলতথাস্তু মা-মণি। তারপর সে উচ্চিংড়েকে কড়া রকমের ও গোবরাকে মৃদু রকমের শাসন করিয়া দিল। অর্থাৎ দুই জনকেই দুই রকমের কান মলিয়া দিল।
কিন্তু তাহাই কি হয়?
উচ্চিংড়ে আর গোবরা হোম-সংক্রান্তি, অর্থাৎ গাজনের দিন কি ঘরে থাকিবে? সেই ভোররাত্রেই ঢাক বাজিবার সঙ্গে সঙ্গেই উচ্চিংড়ে গোবরাকে লইয়া বাহির হইল, আর বাড়িমুখো হইল না,পাছে পদ্ম তাহাদের আটক করে।
আজ বুড়োশিবের পূজা। পূজা হইবে, বলিদান হইবে, হোম হইবে। আজ ভক্ত শুইয়া থাকিবে সমস্ত দিন। লোহার কাঁটাওয়ালা তক্তাখানা এমনভাবে বসানো আছে যে ঘুরাইলে বনবন করিয়া ঘোরে।
উচ্চিংড়ে গোবরাকে বলিল-আজ ভাই আমরা শিবের উপোস করব।
—উপোস? গোবরার ক্ষুধাটা কিছু বেশি।
–হ্যাঁ। বাবা বুড়োশিবের উপোস। সবাই করে, না করলে পাপ হয়। উপোস করলে মেলা টাকা হয়।
সবাই গাজনের উপবাস করে, এ কথাটা গোবরা অস্বীকার করিতে পারিল না। গাজনের উপবাস প্রায় সর্বজনীন। বাউরিবায়েন হইতে উচ্চতম বর্ণ ব্রাহ্মণ পর্যন্ত আজ প্রায় সকলেরই উপবাস। অনিরুদ্ধের মামলার তদ্বিরে দেবু উপবাস করিয়াই সদরে গিয়াছে। শ্ৰীহরিরও উপবাস। কিন্তু উপবাস করিলেই টাকা হয়—এ কথাটা গোবরা স্বীকার করিতে পারিল না। তাহা হইলে
পণ্ডিত গরিব কেন?
গোবরার অন্তরের একান্ত অনিচ্ছা উচ্চিংড়ে বুঝিল; বলিল—বেশি ক্ষিদে লাগে তো, হুই চৌধুরীদের বাগানে গিয়ে আম পেড়ে খাব! বেশ বড় বড় হয়েছে, বুঝলি? আম পাড়লে চৌধুরীরা কিছু বলবে না, আর ওতে পাপও হবে না।
এবার গোবরার তেমন আপত্তি রহিল না।
–শেষকালে না-হয় কারু বাড়িতে মেগে খাব দুটো।
উঁহুঁ মা-মণি তা হলে মারবে। বলবে—ভিখিরি কোথাকার, বেরো হতভাগারা।
—তবে চল, আমরা মহাগেরাম যাই। সেখানে এখানকার চেয়ে বেশি ধুম। আর সেখানে মেগে খেলে, মা-মণি কি করে জানবে! তাই চল।
গোবরা এ প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া উঠিল।
গ্রামের প্রান্তে একটা জলশূন্য পুকুরের পাড়ে খোঁড়া পুরোহিতের তেঠেঙে ঘোড়াটা ঘাস খাইতেছিল। উচ্চিংড়ে দাঁড়াইল। বলিল—এই, ঘোড়াটা ধর দিকি!