ডেটিনিউ যতীনের ঘরের দাওয়ায় বসিয়া ছিল দারোগা। তাহার সম্মুখে জমিয়া দাঁড়াইয়া ছিল একটি জনতা। সেই দারোগা হইতে সমবেত জনতা আকস্মিক বিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
অনিরুদ্ধ বলিয়াছিল—কাল রেতে টাঙি দিয়ে আমি বেবাক গাছ কেটেছি; জাফরি দুটো তুলে ফেলে দিয়েছি চরখাই পুকুরের জলে।
মিথ্যা কথা নয়। ধারালো টাঙি দিয়া অনিরুদ্ধ তাহাদের গাছ কাটার প্রতিশোধ তুলিয়াছে ছিরু পালের ওপর। উন্মত্ত প্রতিশোধের আনন্দে গাছ কাটিতে কাটিতে সে সেই অন্ধকার রাত্রে নাচিয়া নাচিয়া ঘুটিয়া বেড়াইয়াছে, আর ছোট ছেলেদের মত মুখে বলিদানের বাজনার বোল আওড়াইয়াছে—খা-জ্জিং-জ্জিং-জিনাক-জিং-জিং না-জিং-জিং-জিনাক। এ কথা কেহ জানে না, সে কাহাকেও বলে নাই, এমনকি পদ্মকে পর্যন্ত না। ওই ছেলে দুটাকে লইয়া পদ্ম আজকাল পৃথক শুইয়া থাকে; রাত্রে নিঃশব্দে অনিরুদ্ধ উঠিয়া গিয়াছিল, ফিরিয়াছেও নিঃশব্দে। সকালবেলা হইতে সে ছিকর আস্ফালন শুনিয়া মনে মনে কৌতুক বোধ করিয়াছে, পুলিশ আসিলেও সে একবিন্দু ভয় পায় নাই। ভোরবেলাতেই টাঙ্গিখানাকে সে আগুনে পোড়াইয়া সকল অপরাধের চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করিয়াছে। কাপড়খানাতে অবশ্য কলার কষ লাগিয়াছে—সেখানাকে অনিরুদ্ধ খিড়কির ঘাটে জলের তলায় পুঁতিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু যখন দেবু পণ্ডিতকে দারোগা গ্রেপ্তার করিল—তখন সে চমকিয়া উঠিল।
তাহার মনে একটা প্রবল ধাক্কা আসিয়া লাগিল। এ কি হইল? পণ্ডিতকে গ্রেপ্তার করিল? দেবুকে? এই মাত্র কিছুদিন হইল সে জেল হইতে ফিরিয়াছে। বিনাদোষে আবার তাহাকে ধরিল? এ গ্রামের সকলের চেয়ে ভালমানুষ, দশের উপকারী, তাহার পাঠশালার বন্ধু বিপদের মিত্র দেবুকে ধরিল? জগনকে ধরিল না, হরেনকে ধরিল না, তাহাকে ধরিল না? ধরিল পণ্ডিতকে? জনতার মধ্যে চুপ করিয়া মাটির দিকে সে ক্ষুব্ধ বিষণ্ণ মুখে ভাবিতেছিল। তাহার অপরাধের দণ্ড ভোগ করিতে দেবু-ভাই জেলে যাইবে? সমস্ত লোকগুলিই নীরবে হায়-হায় করিতেছে। আক্ষেপে সে অধীর হইয়া উঠিল। ভাবিতে ভাবিতে সে আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। একটা অদ্ভুত ধরনের আবেগের প্রাবল্যে দৃপ্ত ভঙ্গিতে সে দারোগার নিকট আসিয়া নিজের হাত বাড়াইয়া বলিল, দেবু পণ্ডিতের বদলে আমাকে ধরা ও গাছ কাটে নাই, গাছ কেটেছি আমি।
মুহূর্তে সমস্ত জনতা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। একটা স্তব্ধতা থমথম করিতে লাগিল। দারোগা পর্যন্ত অনিরুদ্ধের দিকে বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। সেই স্তব্ধ এবং বিস্মিত পরিমণ্ডলের মধ্যে অনিরুদ্ধ সোচ্চারে নিজের সমস্ত দোষ কবুল করিয়া ফেলিল।
***
এ স্তব্ধতা প্রথম ভঙ্গ করিল দেবু। উচ্চিংড়ের কাছ হইতে খবর পাইয়া বাড়ি হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া থরথর কম্পিত কণ্ঠে বলিল, অনি-ভাই, অনি-ভাই,কিছু ভেবো না অনি-ভাই! আমি প্রাণ দিয়ে তোমাকে ছাড়াতে চেষ্টা করব।
অনিরুদ্ধ উত্তর দিতে পারিল নাগভীর আনন্দে বোকার মত আকৰ্ণবিস্তার হাসিয়া দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অকস্মাৎ তাহার চোখ হইতে দরদর ধারে জল গড়াইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে দেবুও কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার সঙ্গে আরও অনেকে, এমনকি যতীন এবং দারোগা পর্যন্ত চোখ মুছিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের প্রত্যেকেই অনিরুদ্ধকে সাধুবাদ দিল।মানুষের মত কাজ করলে অনিরুদ্ধ এবার! এ একশোবার! শাবাশ, অনিরুদ্ধ, শাবাশ!
ইহারই মধ্যে একটি উচ্চকণ্ঠ জনতার পিছন হইতে ধ্বনিত হইয়া উঠিল—শাবাশ ভাই শাবাশ! একশোবার শাবাশ!
বিচিত্র ব্যাপার, এ কণ্ঠস্বর সর্বস্বান্ত ভিক্ষুক তারিণী পালের। উচ্চিংড়ের বাবার। লোকটা কালো, লম্বা, দাঁত উঁচু, খানিকটা ক্ষ্যাপাক্ষ্যাপা। অনিরুদ্ধের এই কাজটির মধ্যে সে কি করিয়া এক মহোল্লাসের সন্ধান পাইয়াছে।
বাড়ির ভিতরে পদ্ম নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, চোখ দিয়া তাহার শুধু জলই ঝরিতেছিল। তাহার বাক্য হারাইয়া গিয়াছে, চোখের জল গলিয়া গলিয়া পড়িতেছে। দুর্গা দাঁড়াইয়া ছিল অল্প দূরে। উচ্চিংড়ে ও গোবরা কাছেই ছিল; অনিরুদ্ধ ভিতরে আসিতেই তাহারা সরিয়া গেল। অনিরুদ্ধ এতক্ষণে সপ্রতিভভাবে হাসিয়া সকলের দিকে চাহিয়া বলিল—চললাম তা হলে!
পদ্মের তখনও ভাত হয় নাই, যতীনেরও অল্প দেরি আছে। দেবু বলিল-আমার জন্য ভাতে-ভাত হয়েছে অনি-ভাই, তাই দুটো খেয়ে নেবে, চল।
দেবুর ঘরেই খাইয়া অনিরুদ্ধ থানায় চলিয়া গেল।
যাইবার সময় দারোগা দুর্গাকে একটা তলব দিয়া গেল, থানাতে যাবি একবার। তোর নামেও একটা রিপোর্ট হয়েছে।
আজ যতীন নিজে রান্না করিল। উদ্যোগ করিয়া দিল উদ্দিংড়ে এবং গোবরা। দূরে দাঁড়াইয়া সমস্ত বলিয়া দিল দুর্গা।
পদ্ম কিছুক্ষণ ঘরে বসিয়া ছিল, তাহার পর গিয়া বসিল খিড়কির ঘাটে। সেখানে বসিয়া। তীক্ষ্মস্বরে নামহীন কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ করিয়া তীব্র নিষ্ঠুরতম অভিসম্পাত দিতে আরম্ভ করিল।
—শরীরে ঘুণ ধরবে, আকাট রোগ হবে। শরীর যদি পাথর হয় তো ফেটে যাবে, লোহার হয় তো চলে যাবে। অলক্ষ্মী ঘরে ঢুকবে লক্ষ্মী বনবাস যাবে। ঘরে আগুন লাগবে, ধানের মরাই ছাইয়ের গাদা হবে।
মনের ভিতর রূঢ়তর অভিসম্পাতের আরও চোখা-চোখা বাণী ঘুরিতেছিল—বউবেটা মরবে, পিণ্ডি লোপ হবে, জোড়া বেটা এক বিছানায় শুয়ে ধড়ফড় করে যাবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনের কোণে উঁকি মারিতেছিল—বিশীর্ণ গৌরবর্ণা এক সীমন্তিনী নারীর অতি কাতর করুণা-ভিক্ষু মুখ। অল্পে অল্পে সে চুপ করিয়া গেল।