দুর্গা আসিয়া দাঁড়াইল।–জামাই-পণ্ডিত।
দুৰ্গা দেবু যতীনের তক্তপোশে শুইয়া ছিল, উঠিয়া বসিল। হ্যাঁ। বাড়ি এস।
কেন রে?
পুলিশ এসেছে, ঘর দেখবে। ডাক্তার, আপনার ঘরের সামনেও সিপাই দাঁড়িয়েছে। হরেন সর্বাগ্রে উঠিয়া বলিলমাই গড! মায়ের গীতাটা নিয়ে হয়েছে আমার মরণ।
একজন পুলিশের কনস্টেবল জনতিনেক চৌকিদার লইয়া আসিয়া অনিরুদ্ধের তিন দরজায় পাহারা দিয়া বসিল।
পথে যাইতে যাইতে দুর্গা বলিল জামাই-পণ্ডিত।
—কি রে?
–ঘরে কিছু থাকে তো আমাকে দেবে। আমি ঠিক পেট-অ্যাঁচলে নিয়ে বাইরে চলে যাব।
–কি থাকবে আমার ঘরে? কিছু নাই!
বাড়ির দুয়ারে সাব-ইন্সপেকটার নিজে ছিল; সে বলিলপণ্ডিত, আপনার ঘর আমরা সার্চ করব। দুগ্গা, তুই ভেতরে যাস নে!
দুর্গা বলিল—ওরে বাবা, দুধের ঘটি রয়েছে যে দারোগাবাবু! আবার আমাকে নিয়ে পড়লেন। ক্যানে?
হাসিয়া দারোগা বলিল-তুই ভারি বজ্জাত। কোথায় ঘটি আছে বল চৌকিদার এনে দেবে।
দেবু বলিল—আসুন দারোগাবাবু। দুর্গা তুই বোস, ঘটি আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দারোগা বলিল-ঝরঝরে জায়গায় বোস, দুৰ্গা দেখিস–সাপে কি বিয়ে কামড়ায় না যেন!
দেবু একটা জিনিসের কথা ভাবে নাই।
পুলিশ বাড়ি-ঘর অনুসন্ধান করিয়া, দা-কুড়ুল-কাটারি বেশ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তাহার মধ্যে গতরাত্রের কচি গাছ কাটার কোনো চিহ্ন আছে কি না। কিন্তু সেসব কিছু। পাওয়া গেল না। কাঁচা কাপড়গুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিল—তাহাতে কলাগাছের কষের চিহ্ন আছে কি না। কিন্তু তাও ছিল না। পুলিশ লইল নূতন প্রজা-সমিতির খাতাপত্রগুলি। এই খাতাপত্রগুলির কথাই দেবুর মনে ছিল না। অন্য সকলের বাড়ি হইতে পুলিশ শুধু-হাতেই ফিরিয়া আসিয়াছিল।
শ্ৰীহরি যতীনের নামেও এজাহার দিয়াছিল—তাহাকেও তাহার সন্দেহ হয়। শ্রীহরির বন্ধু। জমাদার সাহেব হইলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু সাব-ইন্সপেকটার শ্ৰীহরির এ কথা গ্ৰাহ্যই করিল না। বলিল—ঘোষমশায়, সবেরই মাত্ৰা আছে, মাত্রা ছাড়িয়ে যাবেন না।
এ সংসারে যাহারা আপন সত্যের বিধান লঙ্ন করিতে চায়—বিধাতাকে সবচেয়ে বেশি মানে তাহারাই। বিধাতার তুষ্টিলাভ করিলে সর্বপ্রকার বিধান-লঙ্ন-জনিত অপরাধের দণ্ড লঘু হইয়া যায়—এই বিশ্বাসই তাহাদের জীবনে পরম আশ্বাস। শ্ৰীহরি তাড়াতাড়ি বলিলনানা-না। ওটা আমারই ভুল। ও আপনি ঠিক বলেছেন।
যাহা হউক, দেবুর ঘর তল্লাশ করার পর দারোগা বলিলপণ্ডিত, আপনাকে আমরা অ্যারেস্ট করছি। আপনি প্রজা-সমিতির প্রেসিডেন্ট, এ কাজটা প্রজা-সমিতির দ্বারাই হয়েছে। বলেই সন্দেহ হচ্ছে আমাদের। অবশ্য এনকোয়ারি আমাদের এখনও শেষ হয় নি; উপস্থিত আপনাকে অ্যারেস্ট করলাম। চার্জটা অবিশ্যি থেফট!
দেবু বলিল—থে চার্জ—চুরি? আমার বিরুদ্ধে?
হাসিয়া দারোগা বলিল গাছ কাটা তো আছেই, সেটার সমন করবেন এসডিও। ঘোষের দুটো লোহার তারের জাফরি চুরি গেছে।
—আমাকে চুরির চার্জে চালান দেবেন দারোগাবাবু? দেবু মর্মান্তিক আক্ষেপের সহিত প্রশ্ন করিল।
অর্জুনের মত বীরকে সময়-দোষে নপুংসক সাজতে হয়েছিল, জানেন তো পণ্ডিত! ও নিয়ে দুঃখু করবেন না। বেলা তো অনেক হয়ে গেল, খাওয়াদাওয়া সেরেই নিন।
দারোগার কথায় দেবু আশ্চর্য রকমের সান্ত্বনা পাইল। সে হাসিয়া বলিল—আপনি একটু জল-টল খাবেন?
–চাকরি পেটের দায়ে পণ্ডিত। খাব নিশ্চয়। তবে আপনার ঘরেও না, ঘোষের ঘরেও নয়। আমাদের যতীনবাবু আছেন। ওখানেই যা হয় হবে।
দারোগা আসিয়া যতীনের ওখানে বসিল।
গ্রামের লোকেরা অবনত মস্তকে চারিপাশে বসিয়া ছিল। সকলেই সবিস্ময়ে ভাবিতেছিল–কে এ কাজ করিল।
মেয়েরা আসিয়া জড়ো হইয়াছে—দেবুর বাড়ি। অনেকে উঠানের উপর ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে, কেহ কেহ দাওয়ার উপর বসিয়া পড়িয়াছে। বিলু যেন পাথর হইয়া গিয়াছে। দুর্গার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতেছে অনর্গল ধারায়। রাঙাদিদির আর বিলাপের শেষ নাই। পদ্ম বসিয়া আছে বিলুর পাশে। বিলুর দুঃখে সেও অপরিসীম দুঃখ অনুভব করিতেছে। মনে হইতেছে—আহা, এ দুঃখের ভার যদি সে নিজে লইয়া বিলুর দুঃখ মুছিয়া দিতে পারি। অবগুণ্ঠনের মধ্যে তাহার চোখ হইতেও টপ টপ করিয়া জল মাটির উপর ঝরিয়া পড়িতেছে।
অকস্মাৎ ছুটিয়া আসিল উচ্চিংড়ে। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে সুকৌশলে মাথা গলাইয়া একেবারে পদ্মের কাছে আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল—শিগগির বাড়ি এস মা-মণি!
যতীনের দেখাদেখি সে-ও পদ্মকে মা-মণি বলে।
পদ্ম বিরক্ত হইয়া ঘাড় নাড়িয়া ইঙ্গিতে প্ৰশ্ন করিল—কেন?—সে অবশ্য বুঝিয়াছে, যতীনের তলব পড়িয়াছে, চাকরিতে হইবে।
–কম্মকারকে যে দারোগাবাবু ধরে নিয়ে যাচ্ছে গো!
পদ্মের বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল। তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল। অনিরুদ্ধকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে! সে আবার কি কথা! একা পদ্ম নয়, কথাটায় সকলেই সচকিত হইয়া উঠিল।
দেবু প্রশ্ন করিল—তার আবার কি হল?
কম্মকার যে সাউখুড়ি করে বললে—আমাকে ধর হে। আমি গাছ কেটেছি। দারোগা অমনি ধরলে। বলতে বলতেই উচ্চিংড়ে যেমন ভিড়ের ভিতর দিয়া সুকৌশলে মাথা গলাইয়া প্রবেশ করিয়াছিল, তেমনি সুকৌশলেই বাহির হইয়া গেল।
কোনোরূপে আত্মসংবরণ করিয়া পদ্মও মেয়েদের ভিড় ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিল।
কামার-বউ! পদ্ম পিছন ফিরিয়া দেখিল, ডাকিতেছে দুর্গা।
—দাঁড়াও, আমিও যাব।
উচ্চিংড়ে কথাটা গুছাইয়া বলিতে পারে নাই, কিন্তু মিথ্যা বলে নাই। সত্যই বলিয়াছে। স্তব্ধ জনতার মধ্য হইতে নিতান্ত অকস্মাৎ অনিরুদ্ধ চোখ-মুখ দৃপ্ত করিয়া দারোগার সম্মুখে বুক ফুলাইয়া আসিয়া বলিয়াছিল—দেবু পণ্ডিতের বদলে আমাকে ধর। ও গাছ কাটে নাই, গাছ কেটেছি আমি।