আকাশ লাল হইয়া উঠিতেছে। যতীন নদীর বালির উপর গিয়া দাঁড়াইল। পূর্বদিগন্তে চৈত্রের বালুকাগৰ্ভময়ী ময়ূরাক্ষী ও আকাশের মিলন-রেখায় সূর্য উঠিতেছে। কয়েকদিন পরেই মহাবিষুবসংক্রান্তি। ময়ূরাক্ষী এখানে ঠিক পূর্ববাহিনী।
ময়ূরাক্ষী পার হইয়া সে জংশনের ঘাটে উঠিল। সপ্তাহে দুই দিন তাহাকে থানায় গিয়া হাজিরা দিতে হয়। অন্যান্য দিন সে চা খাইয়া থানায় যায়। আজ ভোরবেলার নেশায় সে বাহির হইয়া এতটা যখন আসিয়ছে; তখন জংশনে হাজিরার কাজটা সারিয়া যাওয়াই ঠিক করিল।
গ্রামের পথে পা দিয়াই যতীন আবার এক হাঙ্গামার সংবাদ পাইল। হাঙ্গামায় হাঙ্গামায় কয়েকদিন হইতেই গ্রামখানার মন্থর জীবনযাত্রা অকস্মাৎ যেন তালভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। আজ শ্ৰীহরির বাগানে কে বা কাহারা গাছ কাটিয়া তছনছ করিয়া দিয়াছে। গুজবে, জটলায়, উত্তেজনায় গ্রামখানা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপে আটচালায় শ্রীহরি ঘোষ রাগে-দুঃখে অধীর হইয়া প্রায় মাথার চুল ছিঁড়িয়া বেড়াইতেছে। অকস্মাৎ তাহার মধ্য হইতে আজ বাহির হইয়া আসিয়াছে পূর্বের সেই বর্বর ছিরু পাল।
গ্রাম হইতে অল্প দূরে–উত্তর মাঠে অর্থাৎ যেদিকে ময়ূরাক্ষী নদী—তাহার বিপরীত দিকে, বন্যাভয়-নিরাপদ মাঠের মধ্যে একটা মজা পুকুরে পঙ্কোদ্ধার করিয়া সেই পুকুরের চারিপাশে শ্ৰীহরি শখ করিয়া বাগান তৈয়ারি করিয়াছিল। অতীত দিনের চাষী ছিরুর সৃষ্টির নেশার সঙ্গে বর্তমানের আভিজাত্যকামী শ্ৰীহরির কল্পনা মিশাইয়া বাগানখানি রচিত হইয়াছিল। বহু দামি কলমের বহু চারা আনিয়া পুঁতিয়াছিল শ্ৰীহরি, মালদহ মুর্শিদাবাদ হইতে আমের কলম, কলিকাতা হইতে লিচু-জামরুলের কলম ও নানা স্থান হইতে কানাইবাশি, অমৃতসাগর, কাবুলী প্রভৃতি। কলার চারা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল। শুধু ফলের কামনাই নয়, ফুলের নেশাও তার ছিল–অশোক, চাপা, গোলাপ, গন্ধরাজ, বকুলের গাছও অনেকগুলি লাগাইয়াছিল।
শ্ৰীহরির কল্পনা ছিল আরও অনেক। বাগানের মধ্যে শৌখিন দুই-কামরা একখানি ঘর, ঘরের সামনে পুকুরের দিকে খানিকটা বাঁধানো চত্বর হইতে নামিয়া যাইবে একটি বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি। সেই কল্পনায় কাঁচা ঘাটের দুই পাশে দুইটি কনকচাপার গাছ পুঁতিয়াছিল। অশোক ফুলের চারা বসাইয়াছিল—বাগানে ঢুকিবার পথের পাশেই। গাছগুলি বেশ একটু বড় হইলেই গোড়া বাঁধাইয়া বসিবার স্থান তৈয়ারি করিবার ইচ্ছা ছিল। সন্ধ্যায় সে বন্ধু-বান্ধব লইয়া বাগানে আসিয়া বসিবে, ইচ্ছা হইলে রাত্রে আনন্দ করিবে। গান-বাজনা-পান-ভোজন কঙ্কণার বাবুদের মত।
গতরাত্রে কে বা কাহারা শ্ৰীহরি ঘোষের সেই বাগানটিকে কাটিয়া তছনছ করিয়া দিয়াছে। শ্ৰীহরি বলিতেছে—চিৎকার করিয়া বলিতেছে—তাদেরও মাথায় কোপ মিরব আমি!
তাহার ধারণা যাহাদের গাছ সে কাটিয়াছে, এ কাজ তাহাদেরই। পঞ্চপাণ্ডবের প্রতি আক্ৰোশে অশ্বথামা যেমন নিষ্ঠুর আক্রমণে অন্ধকারের আবরণে পাণ্ডব শিশুগুলিকে হত্যা করিয়াছিল তেমনি আক্ৰোশেই কাপুরুষ শত্ৰু তাহার শখের চারা গাছগুলিকে নষ্ট করিয়াছে। শ্ৰীহরি ছাড়িবে না, অশ্বথামার শিরোমণি কাটিয়া সে প্রতিশোধ লইবে। থানায় খবর পাঠানো হইয়াছে। পথে ভূপালের সঙ্গে যতীনের দেখা হইয়াছে।
হরেন ঘোষাল দস্তুরমত ভড়কাইয়া গিয়াছে। শ্ৰীহরির এই মূর্তিকে তাহার দারুণ ভয়। সে আমলে ছিরু পাল তাহাকে একদিন জলে ড়ুবাইয়া ধরিয়াছিল-ঘাড়ে ধরিয়া মুখ মাটিতে রগড়াইয়া দিয়াছিল। সে ব্রাহ্মণ বলিয়া ভয় করে না, ভদ্রলোক বলিয়া খাতির করে না। যতীন। ফিরিতেই সে শুষ্কমুখে আসিয়া কাছে বসিল, বলিল-যতীনবাবু, কেস ইজ সিরিয়াস! ভেরি সিরিয়াস! ছিরু পাল ইজ ফিউরিয়াস্! হি ইজ এ ডেঞ্জারাস ম্যান!
জগন ঘোষ খুব খুশি হইয়াছে। সে ইহাকে সর্বোত্তম সূক্ষ্ম বিচারক বিধাতার দণ্ডবিচারের সঙ্গে তুলনা করিয়াছে। থার্ড ক্লাস পর্যন্ত পড়া বিদ্যায় সে আজ দেবভাষায় ইহার ব্যাখ্যা করিয়া দিলষণ্ডস্য শত্ৰু ব্যাঘ্রেন নিপাতিতঃ। অর্থাৎ ষাড়ের শত্ৰু বাঘে মারিয়াছে।
দেবু বলিলনা ডাক্তার, কাজটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। ছিঃ!
—তোমার কথা বাদ দাও ভাই, তুমি হলে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
দেবু কোনো উত্তর দিল না; রাগও করিল না। সে সত্য সত্যই দুঃখিত হইয়াছে। ওই গাছগুলি শ্ৰীহরি যত্নে পুঁতিয়াছিল—ফলও সে ভোগ করিত। শ্ৰীহরি তাহার গাছ কাটিয়াছে, তবু দুঃখ সে পাইয়াছিল। কাজটা অন্যায়। গাছপালার উপর তাহার বড় মমতা। ওইসব গাছ বড় হইত, ফুলেফলে ভরিয়া উঠিত প্রতিটি বৎসর; পুরুষানুক্রমে তাহারা বাড়িয়া চলিত। মানুষের চেয়ে গাছের পরমায়ু বেশি। শ্ৰীহরি, শ্ৰীহরির সন্তানসন্ততি তাহার উত্তরাধিকারী। তাহারও পরের পুরুষ ওই গাছের ফলে-ফুলে পরিতৃপ্ত হইত। দেবতার ভোগ দিত, গ্রামে বিলাইত, লোক তৃপ্ত হইত। সে গাছ কি এমনভাবে নষ্ট করিতে আছে?
ভো শব্দে দৌড়াইয়া আসিয়া উচ্চিংড়ে বলিল—দারোগা এসেছে।
হরেন চমকাইয়া উঠিল—কোথায়?
উচ্চিংড়ে তখন বাড়ির মধ্যে গিয়া ঢুকিয়াছে। জবাব দিল গোবরা, সে উচ্চিংড়ের পিছনে ছিল, বলিল—সেই পুকুর দেখে গাঁয়ে আসছে।
এবার জগনও শঙ্কিত হইয়া উঠিল, বলিল—যতীনবাবু, বেটা নিশ্চয় আমাদের সবাইকেই সন্দেহ করে এজাহার দেবে। পুলিশও বোধহয় আমাদেরই চালান দেবে। জামিনটামিনের ব্যবস্থা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে। আপনি কংগ্রেসের সেক্রেটারিকে চিঠি লিখে রাখুন।