দেবু বলিল—দেখলেন?
যতীন হাসিয়া বলিল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।
—কি ভাবছি আমি বুঝলেন? আমি একা পড়ে গিয়েছি!
কিছুক্ষণ পর যতীন বলিল—আপনি তা হলে বিবাদ মিটিয়ে ফেলুন দেবুবাবু। সত্যই বড় কষ্টে পড়বেন আপনি।
দেবু হাসিল, বলিলনা, ও ভাবনা আর ভাবিনে। ভাবছি—এতদিনের গাজন, আমাদের গ্রামে গাজনে কত ধুম ছিল, সমস্ত গ্রামের লোক প্রাণ দিয়ে খাটত। অন্য গাঁয়ের সঙ্গে আমাদের গাজনের ধুমের পাল্লা চলত। সেসব উঠে যাবে। নয়ত শ্ৰীহরির একলার হাতে গিয়ে পড়বে। দেবতাতে সুদ্ধ আমাদের অধিকার থাকবে না! ভগবানে আমাদের অধিকার থাকবে না। আমাদের ভগবান পর্যন্ত কেড়ে নেবে।
নেলো আসিয়া দাঁড়াইল।
যতীন বলিল—কি সংবাদ নলিন?
—আট আনা পয়সা। গাজনে এবার মেলা বসাবে ঘোষমশায়। পুতুল তৈরি করে বিক্রি করব। রং কিনব।
—মেলা বসাবে শ্রীহরি? দেবু উঠিয়া বসিল।
নলিনকে বিদায় করিয়া যতীন বলিলনলিনের হাতটি চমৎকার।
দেবু বলিল–ওর মাতামহ যে ছিল নামকরা কুমোর।
–কুমোর! নলিন তো বৈরাগী!
–হ্যাঁ। কাচের পুতুলের চল হল, শেষ বয়সে অভাবে পড়ে বুড়ো ভিক্ষে ধরে বোষ্টম হয়েছিল। তা ছাড়া বিধবা মেয়েটার বিয়ের জন্যও বোষ্টম হওয়া বটে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া দেবু আবার বলিল—শ্ৰীহরি এবার তা হলে ধুম করে গাজন করবে দেখছি!
২৫. ঢাকের বাজনার শব্দ
ঢাকের বাজনার শব্দে ভোরবেলাতেই–ভোরবেলা কেন—তখনও খানিকটা রাত্রি ছিল, যতীনের ঘুম ভাঙিয়া গেল। গাজনের ঢাক। পূর্বে চৈত্রের প্রথম দিন হইতেই গাজনের ঢাক বাজিত। গতবার হইতে পাতু দেবোত্তর চাকরান জমি ছাড়িয়া দেওয়ার পর, চৈত্রের বিশ তারিখ হইতে ঢাক বাজিতেছে। ভিন্ন গ্রামের একজন বায়েনের সঙ্গে নগদ বেতনে নূতন বন্দোবস্ত হইয়াছে। শেষরাত্রিতে ঢাকের বাজনাযতীনের বেশ লাগিল। ঢাকের বাজনার মধ্যে আছে একটা গুরুগম্ভীর প্রচণ্ডতা। রাত্রির নিস্তব্ধ শেষ প্রহরে প্রচণ্ড গম্ভীর শব্দের মধ্যেও একটি পবিত্রতার বেশ সে অনুভব করিল। দরজা খুলিয়া সে বাহিরে আসিয়া বসিল।
সে আশ্চর্য হইয়া গেল;—গ্রামখানায় এই শেষরাত্রেই জাগরণের সাড়া উঠিয়াছে। ভেঁকিতে পিড় পড়িতেছে; মেয়েরা ইহারই মধ্যে পথে বাহির হইয়াছে। হাতে জলের ঘটি। চণ্ডীমণ্ডপে জল দিতে চলিয়াছে। রাঙাদিদি বড় বড় করিয়া তেত্ৰিশ কোটি দেবতার নাম করিতেছে-এখান হইতে শোনা যাইতেছে। জনকয়েক গাজনের ভক্ত স্নান শেষ করিয়া ফিরিতেছে—তাহারা ধ্বনি দিতেছে—বলো শি-বো-শিবো-শিবো-হে! হর-হর বোম্—হর-হর বোম্!
যতীন সকালেই ওঠে, কিন্তু এই শেষরাত্রে সে কোনোদিন ওঠে নাই। পল্লীর এ ছবি তাহার কাছে নূতন। সে যখন ওঠে, তখন রাঙাদিদি ভগবানকে এবং পিতৃপুরুষকে গালিগালাজ আরম্ভ করে। মেয়েদের ঘরের পাট-কাম দেবাচনা শেষ হইয়া গৃহকর্ম আরম্ভ হইয়া যায়।
অনিরুদ্ধের বাড়ির খিড়কির দরজা খুলিয়া গেল। আবছা অন্ধকারের মধ্যে ছায়ামূর্তির মত উচ্চিংড়ে ও গোবরা বাহির হইয়া গেল। তাহাদের পিছনে বাহির হইয়া আসিল পদ্ম, তাহার হাতেও জলের ঘটি।
একটানা ক্যাঁ-কোঁ শব্দে একখানা সারবোঝাই গরুর গাড়ি চলিয়া গেল। শেষরাত্রি হইতেই মাঠের কাজ শুরু হইয়া গিয়াছে। সার ফেলার কাজ চলিতেছে। সারের গাড়িতেই আছে জোয়াল লাঙল। সার ফেলিয়া জমিতে লাঙল চষিবে। সেদিনের জলের রস এখনও জমিতে আছে। মাটির বতর এখন চমৎকার, অর্থাৎ রোদ পাইয়া কাদার আঠা মরিয়া মাটি চমৎকার চাষের যোগ্য হইয়াছে। লাঙলের ফাল কোমল মাটির মধ্যে আকণ্ঠ ড়ুবিয়া চিরিয়া চলিবে নিঃশব্দে, নির্বিঘ্নে, স্বচ্ছন্দ গতিতে ছানার তালের মধ্যে ধারালো ছুরির মতন। বড় বড় চাই দুইপাশে উলটাইয়া পড়িবে; অথচ লাঙলের ফালে এতটুকু মাটি লাগিবে না, সামান্য আঘাতেই চাইগুলা গুঁড়া হইয়া যাইবে। গরু মহিষগুলি চলিবে অবহেলায় ধীর অনায়াস গতিতে। এই কর্ষণের মধ্যে চাষীর বড় আনন্দ। অন্তরে অন্তরে যেন আনন্দের রস ক্ষরণ হয়।
একসঙ্গে সারিবন্দি শোভাযাত্রার মত হাল গেল ছয়খানা; পিছনে চারখানা সারবোঝাই গাড়ি। বড় বড় হৃষ্টপুষ্ট সবলকায় হেলে-বলদগুলি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। এগুলি সবই শ্ৰীহরি ঘোষের। ঘোষের ঘরে দশখানা হাল, কুড়ি জন কৃষাণ। ঘোষের সুপ্ৰসন্ন ভাগ্যদ্টার প্রতিফলন তাহার সর্বসম্পদে সুপরিস্ফুট।
যতীন জামা গায়ে দিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িল। অতিক্ৰম করিয়া আসিয়া পড়িল মাঠে। দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠে। মাঠের প্রান্তে ময়ূরাক্ষীর বাঁধ, বধের গায়ে কচি সবুজ শরবনের চাপ। তাহারই ভিতর হইতে উঠিয়াছে—তালগাছের সারি। মধ্যে মধ্যে পলাশ-পালতে-শিমুল। শিরীষ-তেঁতুলের গাছ। গাছগুলির মাথার উপরে অস্পষ্ট আলোয় উদ্ভাসিত আকাশের গায়ে জংশন-শহরের কলের চিমনী। কলে ভো বাজিতেছে—একসঙ্গে চার-পাঁচটা কলে বাজিতেছে। বোধহয় চারিটা বাজিল।
মাঠ পার হইয়া সে বাধে উঠিল। বাঁধ হইতে নামিল ময়ূরাক্ষীর চর-ভূমিতে। জল পাইয়া চরে বেনাঘাসগুলি সবুজ হইয়া উঠিয়াছে। তাহারই মধ্যে সযত্নকর্ষিত তার ফসলের জমিগুলির গিরিরঙের মাটি বড় চমৎকার দেখাইতেছে। জমির মধ্যে তরকারির চারাগুলি সাপের ফণার মত ডগা বাড়াইয়া লইতে শুরু করিয়াছে। ভোরবেলায় তিতির পাখির দল বাহির হইয়াছে খাদ্যান্বেষণে। উইয়ের ঢিবি, পিঁপড়ের গর্ত ঠোকরাইয়া উই ও পিঁপড়ে খাইয়া ফিরিতেছে। যতীনের সাড়ায় কয়টা তিতির ফরফর শব্দে উড়িয়া দূরে গিয়া জঙ্গলের মধ্যে লুকাইল।