দাশজী বলিল কিনে ফেল ঘোষ। তোমার পয়সা আছে। জমিদারি হল অক্ষয় সম্পত্তি। তা ছাড়া–এই গাঁয়ের যারা তোমার শত্ৰু-একদিনে তোমার পায়ে গড়িয়ে পড়বে। সেটেলমেন্ট ফাইনাল পাবলিকেশনের আগেই কেনো। দরখাস্ত করে নাম সংশোধন করিয়ে নাও। ফাইনাল পাবলিকেশনের পর পাঁচধারার কোৰ্ট পাবে। টাকায় চার আনা বৃদ্ধি তো হবেই। আট আনার নজির হাইকোর্ট থেকে নিয়ে রেখেছি। শোন, আমি সুধিবা দরে করে দেব। হ্যাঁ, দরজাটা বন্ধ করে দাও দেখি।
শ্ৰীহরি দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
দীর্ঘকাল পরামর্শ করিয়া হাসিতে হাসিতেই দুজনে বাহির হইল। দাশজী বলিল–ও নোটিশ তোমার বাজে, একদম বাজে নোটিশ দিয়েছে। তুমি যদি যাও—তার ফলে শান্তিভঙ্গ ঘটে। তবে হেনো হবে তেনো হবে, এই তো?
তারপর মুখের কাছে মুখ আনিয়া ভঙ্গি করিয়া নাড়িতে নাড়িতে বলিল—কিন্তু শান্তিভঙ্গ যদি না হয়, তা হলে? দাশজী ঠোঁট টিপিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল।
শ্ৰীহরি বলিল—তবে আমি নিশ্চিন্দি হয়ে করতে পারি?
–নিশ্চয়, তবে সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে। কোনো হাঙ্গামা যেন না হয়।
–আর গাজনের কি করব?
–যা হয় কর।
–চণ্ডীমণ্ডপ তা হলে যেমন আছে তেমনি থাক।
–ওই কাজটি কোরো না ঘোষ। আমি বারণ করছি। চণ্ডীমণ্ডপের সেবাইত জমিদার বটে, কিন্তু অধিকার গাঁয়ের লোকের। পাকা নাটমন্দির, দেবমন্দির নিজের বাড়িতে কর। সম্পত্তি থাকতেও আছে—যেতেও আছে। যদি কোনোদিন সম্পত্তি চলেও যায় তখন আর কোনো অধিকার থাকবে না তোমার।
দাশজী শ্ৰীহরিকে চণ্ডীমণ্ডপের উপর টাকা খরচ করিতে নিষেধ করিতেছে। যে দিন-কাল পড়িয়াছে। সাধারণের জিনিসে নিজের টাকা খরচ করা মূৰ্খতা মাত্র।
***
পরদিন প্রাতঃকালেই গ্রামে আর একটা হইচই উঠিল।
দেবু ঘোষের আধ-কাটা আমগাছটা গতরাত্রেই কাটিয়া কেহ তুলিয়া লইয়াছে। কেহ আর কে? শ্ৰীহরি লইয়াছে। শান্তিভঙ্গ হয় নাই, সুতরাং আইনভঙ্গও সে করে নাই! সদ্যকাটা গাছটার শিকড়ের উপর আঙুল চারেক কাণ্ডটা কেবল জাগিয়া আছে। কাটা গাছটার অবশিষ্ট কোথাও বিশেষ পড়িয়া নাই। কেবল কতকগুলো ঝরা কাঁচা পাতা, কতকগুলো কাঁচা আম, আঙুলের মত সরু দুই-চারটা ডাল, শিকড়-কাটা কতক কুচা পড়িয়া আছে। জমিটার জলসিক্ত নরম মাটিতে গাড়ির চাকার দাগে, গরুর খুরের চিহ্নে, সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখিত রহিয়াছে গত রাত্রের কাহিনী।
ঘোষাল আস্ফালন করিয়া বেড়াইতেছিল—রেগুলার থেট কেস হি ইজ এ থি! হি ইজ এ থি! হ্যান্ডকাফ দিয়ে চালান দেব।
দেবু বারণ করিল–না। ওসব বোলোনা, ঘোষাল!
জগন বলিল-দুপুরের ট্রেনেই চল মামলা রুজু করে আসি।
তাহাতেও দেবু বলিল–না।
ধীর পদক্ষেপে দেবু আসিয়া বসিল যতীনের কাছে।
যতীন বলিল—শুনলাম গাছটা রাতারাতি কেটে নিয়েছে।
জগন বলিল-মামলা করতে বলছি, দেবু রাজি হচ্ছে না।
দেবু একটু ম্লান হাসি হাসিল।
—কি হবে মামলা করে? গাছ আইন অনুসারে জমিদারের। মিছে টাকা খরচ করে কি লাভ?
–এরই মধ্যে যে অবসন্ন হয়ে পড়লেন দেবুবাবু?
–হ্যাঁ। অবসন্ন হয়েছি যতীনবাবু। আর পারছি না।
–দাঁড়ান, একটু চা করি।—উচ্চিংড়ে! উচ্চিংড়ে।
একা উচ্চিংড়ে নয়, সঙ্গে আরও একটা বাচ্চা আসিয়া হাজির হইল।
—চা করতে বল মা-মণিকে।
হরেন বলিল—এটা আবার কোথেকে এসে জুটল? একা রামে রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর!
হাসিয়া যতীন বলিল—উচ্চিংড়ের জংশনের বন্ধু। কাল পিছনে পিছনে এসেছিল গাছ কাটার হাঙ্গামা দেখতে। সেখানে বনের পাখি আর খাঁচার পাখিতে মিলন হয়েছে। উচ্চিংড়ে ওকে নিয়ে এসেছে।
—বেশ আছেন মশায়, নন্দী-ভৃঙ্গী নিয়ে। আপনার কাছেই এসে জোটে সব!
–আমার কাছে নয়। উচ্চিংড়ে ওকে নিয়ে এসেছে মা-মণির কাছে।
–মানে কামার-বউয়ের কাছে?
হাসিয়া যতীন বলিল–হ্যাঁ।
–অনিরুদ্ধ ওকে মেরে তাড়াবে।
—কাল সে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। অনিরুদ্ধবাবু তাড়াতে চেয়েছিলেন। মামণি বলেছেন। ও গরু চরাবেখাবে থাকবে। অনিরুদ্ধবাবু গরু কিনেছেন কিনা। আর কামারশালায় হাপর টানবে।
উচ্চিংড়ে আসিয়া দাঁড়াইল–চা লাও গো বাবু।
ওদিকে ঢাক বাজিয়া উঠিল। উদ্দিংড়ে তাড়াতাড়িতে অর্ধেক চা উপচাইয়া ফেলিয়া, চায়ের বাটিগুলি নামাইয়া দিয়াই—দাওয়া হইতে এক লাফ দিয়া পড়িল; ড্যাং-ডাং-ডাং-ন্যাটাং ড্যাটাং-ডাং-ডাং-ড্যাং–ন্যাটাং ড্যাটাং! আয় রে গোবরা, শিব উঠছে দেখতে যাই।
গাজনের ঢাক বাজিতেছে। পূর্ণ এক বৎসর পরে গাজনের বুড়াশিব পুকুরের জল হইতে উঠিবেন। ভক্তেরা দোলায় করিয়া লইয়া আসিবে।
জগন বলিল–ভক্ত কে কে হল জান, ঘোষাল?
হরেন বলিল–ওলি ফাইব। একটা হাতের অঙ্গুলি প্রসারিত করিয়া সে দেখাইয়া দিল।
–চল, ব্যাপারটা দেখে আসি।
–চল।
জগন, হরেন চলিয়া গেল।
যতীন বলিল—দেবুবাবু!
–বলুন?
কি ভাবছেন?
–ভাবছি—দেবু হাসিল। তারপর বলিল দেখবেন?
–কি?
–আসুন আমার সঙ্গে।
অল্প খানিকটা আসিয়াই শ্ৰীহরির বাড়ি, বাড়ির পর খামার। পথ হইতেই খামারটা দেখা যায়। প্রকাও একটা জনতা সেখানে জমিয়া আছে। খামারের উঠানের মাঝখানে সোনার বর্ণ ধানের একটি স্তুপ। পাশেই তিনটি বাঁশের পোয়াতে বড় বড় ওজনের কাটা-পাল্লা টাঙানো হইয়াছে। একটা গাছের তলায় চেয়ার পাতিয়া বসিয়া আছে শ্ৰীহরি। জনকয়েক লোক দেবু ও যতীনকে দেখিয়া আড়ালে লুকাইয়া দাঁড়াইল। ওদিকে ওজনের পাল্লায় অবিরাম ধান ওজন চলিতেছে—দশ দশ–দশ রামে–ইগার ইগার। ইগার ইগার–ইগার রামে–বার বার।