তাহারা শুনিতে পাইল কি না কে জানে, কিন্তু স্ত্রীলোকটি চিৎকার বন্ধ করিল, পুরুষটিও তাহাকে ছাড়িয়া দিল। চৌধুরী কিছুক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া—আবার রওনা হইল। ছোটলোক কি সাধে বলে। লজ্জা-শরম, রীতকরণ উহাদের কখনও হইবে না। জানে না-স্ত্রীলোকের চুলে হাত দিলে শক্তি ক্ষয় হয়। রাবণ যে রাবণ, যাহার দশটা মুণ্ড, কুড়িটা হাত, এক লক্ষ ছেলে, একশো লক্ষ নাতি, সে যে সে, সীতার চুলের মুঠি ধরিয়া সে একেবারে নির্বংশ হইয়া গেল।
বাঁধের কাছাকাছি চৌধুরী পৌঁছিয়াছে—এমন সময় পিছনে পদশব্দ শুনিয়া চৌধুরী ফিরিয়া চাহিল; দেখিল, পাতু বায়েন হনহন করিয়া বুনো শূকরের মত গোভরে চলিয়া আসিতেছে। পিছনে কিছুদূরে ধুপ ধুপ করিয়া ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছে একটি স্ত্রীলোক। বোধহয় পাতুর স্ত্রী। সে এখনও গুনগুন করিয়া কাঁদিতেছে আর মধ্যে মধ্যে চোখ মুছিতেছে। চৌধুরী একটু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। পাতু যে গতিতে আসিতেছে, তাহাতে তাহাকে পথ ছাড়িয়া না দিলে উপায় কি! উহার আগে আগে চলিবার শক্তি চৌধুরীর নাই। পাতু কিন্তু নিজেই পথ করিয়া লইল, সে পাশের জমিতে নামিয়া পড়িয়া ধানের মধ্য দিয়া যাইবার জন্য উদ্যত হইল। সহসা সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া চৌধুরীকে একটা প্রণাম করিয়া বলিল দ্যাখেন চৌধুরী মশাই দ্যাখেন।
চৌধুরী পাতুর মুখের দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠিল। কপালে একটা সদ্য আঘাতচিহ্ন হইতে রক্ত ঝরিয়া মুখখানাকে রক্তাক্ত করিয়া দিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রী ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল।
–ওগো, বাবুমশায় গো! খুন করলে গো!
–এ্যাঁও! পাতু গর্জন করিয়া উঠিল। আবার চেঁচাতে লাগিলি মাগী?
সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর নামিয়া গেল; সে গুনগুন করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল–গরিবের কি দশা করেছে দেখেন গো, আপনারা বিচার করেন গো!
পাতু পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পিঠ দেখাইয়া বলিল—দেখেন, পিঠ দেখেন।
এবার চৌধুরী দেখিল পাতুর পিঠে লম্বা দড়ির মত নির্মম প্রহার-চিহ্ন রক্তমুখী হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। দাগ একটা-দুইটা নয়—দাগে দাগে পিঠটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত। চৌধুরী অকপট মমতা ও সহানুভূতিতে বিচলিত হইয়া উঠিল, আবেগবিগলিত স্বরেই বলিল—আ-হা-হা! কে এমন কল্লে রে পাতু?
–আজ্ঞে, ওই ছিরু পাল। রাগে গগন্ করিতে করিতে প্রশ্ন শেষ হইবার পূর্বেই পাতু উত্তর দিল-–কথা নাই, বার্তা নাই, এসেই এক গাছা দড়ির বাড়িতে দেখেন কি করে দিলে দেখেন। আবার সে পিছন ফিরিয়া ক্ষতবিক্ষত পিঠখানা চৌধুরীর চোখের সামনে ধরিল। তারপর আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-দড়িখানা চেপে ধরলাম তো একগাছা বখারির ঘায়ে কপালটাকে একেবারে দিল ফাটিয়ে।
ছিরু পাল—শ্ৰীহরি ঘোষ? অবিশ্বাস করিবার কিছু নাই। উঃ, নির্মমভাবে প্রহার করিয়াছে। চৌধুরীর চোখে অকস্মাৎ জল আসিয়া গেল। এক এক সময় অপরের দুঃখ-দুর্দশায় মানুষ এমন বিচলিত হয় যে, তখন নিজের সকল সুখ-দুঃখকে অতিক্ৰম করিয়া নির্যাতিতের দুঃখ যেন আপন দেহমন দিয়া প্ৰত্যক্ষভাবে অনুভব করে। চৌধুরী এমনই একটি অবস্থায় উপনীত হইয়া সজল চক্ষে পাতুর দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার দন্তহীন মুখের শিথিল ঠোঁট অত্যন্ত বিশ্রী ভঙ্গিতে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
পাতু বলিল—মোড়লদের ফিজনার কাছে গেলাম। তা কেউ রা কাড়লে না মশায়। শক্তর সব দুয়োর মুক্ত।
পাতুর বউ অনুচ্চ কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলিতেছিল—সর্বনাশী কালামুখীর লেগে গো—
পাতু একটা ধমক করিয়া বলিল—অ্যাই—অ্যাই, আবার ঘ্যানঘ্যান করে।
চৌধুরী একটু আত্মসংবরণ করিয়া বলিল—কেন অমন করে মারলে? কি এমন দোষ করেছ তুমি যে–
অভিযোগ করিয়া পাতু কহিল—সেদিন চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে বলতে গেলাম–তো আপনি শুনলেন না, চলে গেলেন। গোটা গেরামের লোকের আঙোটজুতি আমাকে সারা বছর যোগাতে হয়, অথচ আমি কিছুই পাই না। তা কর্মকার যখন রব তুললে, তখন আমিও বলেছিলাম যে, আমি আর আঙোটজুতি যোগাতে লারব। কাল সানঝেতে পালের মুনিষ আঙোটজুতি চাইতে এসেছিল—আমি বলেছিলাম-পয়সা আন গিয়ে! তা আমার বলা বটে আজ সকালে উঠে এসেই কথা নাই বাৰ্ত্তা নাই-আথালি-পাথালি দড়ি দিয়ে মার!
চৌধুরী চুপ করিয়া রহিল। পাতুর বউ বার বার ঘাড় নাড়িয়া মৃদু বিলাপের সুরে সেই বলিয়াই চলিল না গো বাবুমশায়—
পাতু তাহার কথা ঢাকিয়া দিয়া বুলিল-আমার পেট চলে কি করেসেটা আপনারা বিচার করবেন না, আর এমনি করে মারবেন?
চৌধুরী কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল—শ্ৰীহরি তোমাকে এমন করে মেরেছে—মহা অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, হাজার বার লক্ষ বার, সে কথা সত্যি; কিন্তু আঙোটজুতির কথাটা তুমি জান না বাবা পাতু! গায়ের ভাগাড় তোমরা যে দখল করতার। জন্যেই তোমাদিগে গায়ের আঙোটজুতি যোগাতে হয়। এই নিয়ম। ভাগাড়ে মড়ি পড়লে তোমরা চামড়া নাও, হাড় বিক্রি কর, তারই দরুন তোমরা ওই আঙোটজুতিমাংস কাটিয়া লইয়া যাওয়ার কথাটা আর চৌধুরী ঘূণাবশে উচ্চারণ করিতে পারিল না।
পাতু অবাক হইয়া গেল; সে বলিলভাগাড়ের দরুন!
–হ্যাঁ। তোমাদের প্রবীণেরা তো কেউ নাই, তারা সব জানত।
—শুধু তাই নয়, মশায়; ওই পোড়ামুখী কলঙ্কিনী গো? এই ফাঁকে পাতুর বউ আবার সুর তুলিল।
পাতু এবার সঙ্গে সঙ্গে বলিল–আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু তো আঙোটজুতিও লয়; আপনারা ভদ্রনোকরা যদি আমাদের ঘরের মেয়েদের পানে তাকান—তবে আমরা যাই কোথা বলুন?