আমি ভালবেসে এই বুঝেছি মুখের সার সে চোখের জলে রে।
তুমি হাস আমি কাঁদি বাঁশী বাজুক কদমতলে রে।
রাজন বলিল—বাঃ, বাঃ, বাঃ! উসকা বাদ?
নিতাইয়ের চোখ দিয়া জল গড়াইতেছিল। সে জল মুছিতে মুছিতে বলিল—আর নাই।
তারপর সে সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় গড়াইয়া পড়িল। মনের মধ্যে অনেক কথা। মামার হাতে লাঞ্ছনার কথাটা তাহার কাছে খুব বড় নয়। মামার কাছে অনেক লাঞ্ছনাই সে ভোগ করিয়াছে। ওটা তাহার অঙ্গের ভূষণ। ও ছাপাইয়া সে ভাবিতেছিল কবিগানের কথা।
বিশেষ করিয়া এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ কবিয়াল তারণ মণ্ডলের কথা। তাঁরণ কবি যে-আসরে গান করিয়াছে, সে আসরে কত লোক! হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে। সে যেবার প্রথম তারণ কবির গান শোনে সেবারকার সে-ছবি এখনও তাহার মনে জলজল করিতেছে।
এই চণ্ডীমায়ের মেলাতেই, সে কি জনতা, আর সে কি গোলমাল! তখন মেলারও সে কি জাঁকজমক! চার-পাঁচটা চাপরাসীই তখন মেলার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বাহাল করা হইত। তাহাদের সঙ্গে থাকিত বাবুদের দারোয়ান এবং দুই-চারিজন বাবু। তবু সে কি গোলমাল! নিতাইয়ের স্পষ্ট মনে পড়িল কলরবমুখর জনতা মুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল, আলোকোজ্জল আসরের মধ্যে তখন তারণ কবি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
এই লম্বা মানুষটি, পাক চুল, পাকা গোফ, কপালে সিন্দূরের ফোঁটা, বুকে সারি-সারি মেডেল, লাল চোখ, তারণ কবির আবির্ভাবেই সব চুপ হইয়া গিয়াছিল। আসরের একদিকে বেঞ্চ পাতিয়া গ্রামের বাবুরা বসিয়া ছিল, তাহারা পর্যন্ত চুপ করিয়া গিয়াছিল। আর সে কি গান!
তারপর হইতে আশেপাশে যখন যেখানে তারণ কবির গান হইয়াছে; সেইখানেই সে গিয়াছে। একবার ভিড়ের মধ্যে হাত বাড়াইয়া সে তারণ কবির পায়ের ধূলাও লইয়াছিল। তখন হইতেই তাহার সাধ, কবিয়াল হইবে। ইচ্ছা ছিল তারণ কবির দলে দেয়ারকি করিয়া সে কবিগান শিখিবে। কিন্তু তারণ মরিয়া গেল। মদ খাইয়াই নাকি তারণ মরিয়াছে। তারণ কবির ওই একটা বড় দোষ ছিল, ভীষণ মদ খাইত। আসরেই তাহার বোতল গের্লাস থাকিত, সকলের সম্মুখেই সে মধ্যে মধ্যে জল বলিয়া-মদ খাইত। ওই তারণ কবি সেদিন গানে গাহিয়াছিল–
“তোমার লাথি আমার বুকে পরম আশীষ শোন দশানন,
তোমার চরণস্থল আমার অঙ্গে অগুরু চন্দন
বিভীষণের রাক্ষস জন্মের শাপবিমোচন,
খালাস, খালাস, খালাস, আমি খালাস নিলাম হে।”
সেদিন পালাতে তারণ হইয়াছিল বিভীষণ এবং প্রতিপক্ষ বিষ্ণু সিং হইয়াছিল রাবণ। সেই কথাটাই আজ বার বার করিয়া মনে পড়িতেছিল। সে আজ খালাস। খালাস। খালাস।
এক একসময় তাহার মনে হয় তার কবি তাহারই কপালদোষে মরিয়া গেল। সে গুরু পাইল না। এমন ভাল গুরু না হইলে কি ভাল কবি হওয়া যায়! শাস্ত্রের কি অন্ত আছে? পড়িয়া শুনিয়া সে সব শিখিতে গেলে এ জীবনে আর কবিয়াল হওয়া হইয়া উঠিবে না। রামায়ণ মহাভারত— সহসা তাহার মনে হইল, মহাদেব আজ রামায়ণ হইতে যে প্রশ্নটা লইইয়া তাহকে অপদস্থ করিয়াছে, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠিয়া বসিল। আলো জ্বালিল।
ছোট একটি চৌকির উপর যত্বের সহিত রঙিন কাপড়ে বাঁধিয়া সে তাহার পুঁথিগুলি রাখিয়া থাকে। দপ্তর খুলিয়া সে রামায়ণ বাহির করিল। দপ্তরের মধ্যে একগাদা বই। পাঠশালা হইতে আজ পর্যন্ত সংগৃহীত বইগুলি সবই তাহার আছে। পথেঘাটে উড়িয়া বেড়ায় যে সমস্ত ছেঁড়া কাগজ ও বইয়ের পাতা, তাহারও অনেকগুলি সংগ্ৰহ করিয়া নিতাই রাখিয়াছে। কাগজ দেখিলেই সে কুড়াইয়া লইয়া পড়িতে চেষ্টা করে। যাহা ভাল লাগে তাহাই সে সযত্বে রাখিয়া দেয়। বইয়ের সংগ্রহ তাহার কম নয়—কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কৃষ্ণের শতনাম, শনির পাঁচালী, মনসার ভাসান, গঙ্গামাহাত্ম্য, স্থানীয় থিয়েটার-ক্লাবের ফেলিয়া-দেওয়া কয়েকখানা ছেঁড়া নাটক; ইহা ছাড়া তাহার পাঠশালার বইগুলি—সে প্রথম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেকখানি আছে। আর আছে থান দুইয়েক খাতা, ভাঙা মেট-পেন্সিল, একটা লেণ্ডপেন্সিল, ছোট একটুকরা লাল-নীল পেন্সিল। আর কিছু ছেঁড়া পাত, খোলা কাগজ।
সেই রত্রেই সে নিবিষ্ট মনে রামায়ণের পাতা উল্টাতেই আরম্ভ করিল। ঠিক, মহাদেব তাহাকে ধাপ্পা মারিয়াই হার মানাইয়াছে। ভুল তাহার নয়, মহাদেবই ভুলকে সত্য করিয়াছে মুখের জোরে। হাসিয়া সে মহাদেবের প্রশ্নের উত্তরের ঠাঁইটা বন্ধ করিয়া রাবণ ও বিভীষণের বিতণ্ডার অধ্যায়টা খুলিল। পড়িয়া বই বন্ধ করিয়া সে আবার শুইরা পড়িল। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসে না। রগের শিরা দুইটা দপদপ করিয়া লাফাইতেছে, কানের পাশে এখনও যেন ঢোল কাঁসির শব্দ উঠতেছে। ধীরে ধীরে শব্দগুলা মৃদ্ধ হইতে মুদ্ভুতর হইতে হইতে একসময় নিস্তব্ধ হইয়া গেল।
ঘুম ভাঙিল রাজার ডাকে।
মিলিটারী রাজা, রাত্রি জাগিয়াও ঠিক সকাল ছয়টায় উঠিয়াছে। সাতটার এ লাইনের ফার্স্ট ট্রেন এ-স্টেশন অতিক্রম করিবে। যুদ্ধ-ফেরত রাজা চা খায়, চারের জল চড়াইয়া দিয়া স্টেশনে সিগন্যাল দিয়া ও ঘণ্টি মারিয়া আসিয়া ওস্তাদকে ডাকিল—ওস্তাদ। ওস্তাদ!
ওস্তাদ না হইলে চা খাইয়া মুখ হয় না। বউটা এখনও ঘুমাইতেছে। ঠাকুরঝি কিন্তু ঠিক আছে, সে রাজার পূর্বেই উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে। ঠাকুরঝির শাশুড়ীটা বড় দজাল। এমন মেয়েটিকেও বড় কষ্ট দেয়। রাজা মনে মনে এখন আপসোস করে,—বউটাকে কেন সে বিবাহ করিল। ঠাকুরঝিকে বিবাহ করিলেই ভাল হইত। ছিপছিপে দ্রুতগামিনী দ্রুতহাসিনী দ্রুতভাষিণী মিষ্ট স্বভাবের ঠাকুরঝি তাহার মুখরা দিদির চেয়ে অনেক ভাল।
নিতাইয়ের সাড়া না পাইয়া রাজা আবার ডাকিল-হো ওস্তাদ!
এবার নিতাই জড়িত স্বরে উত্তর দিল—উঁহু।
—চা হো গেয়া ভেইরা!
–উঁহু।
—আরে ট্রেন আতা হায় ভেইয়া।
–উঁহু।
রাজা নিরুপায় হইয়া চলিয়া গেল। আর ডাকিল না। কাল রাত্রে ওস্তাদের বড়ই খাটুনি গিয়াছে, আজ বেচারার একটু ঘুম দরকার।