সেই মেলাতে কবে যাব
ঠিকানা কি হায়রে!
যে মেলাতে গান থামে না
রাতের আঁধার নাইরে।
ও রসময় ভাইরে!
রাজা শুনিয়া বাহ বাহা করিয়া জড়াইয়া ধরিয়া বলে-ওস্তাদ তুম ভাই গুন তৈয়ার করো। আচ্ছা গান আত তুমার!
গান তাহার অনেক আছে। কিন্তু কোনটাই সম্পূর্ণ হইয়া উঠে না। হঠাৎ চণ্ডীমায়ের মেলাতে এই নিতাই সত্য সত্যই কবিয়াল হইয়া উঠিল।
কবি – ০৪
কবিগানের পাল্লার পর চণ্ডীমায়ের প্রসাদী সিন্দূরমাখানো শুকনো বেলপাতার মালা গলায় দিয়া নিতাই মেলা হইতে বাড়ি ফিরিতেছিল রাজদত্ত মাল্যকণ্ঠে সেকালের দিগ্বিজয়ী কবিদের মত। যেন একটা ভাবের নেশার ঘোরের মধ্যে পথ চলিতেছিল। মনে মনে সে বেশ অনুভব করিতেছিল যে সে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সে একজন কবি।
সমস্ত পথটা তাহার আত্মীয়স্বজন, যাহারা এতদিন তাহার সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখিত না, আজ তাহারা তাহাকে ঘিরিয়া কলরব করিতে করিতে সঙ্গে আসিতেছিল। তাহদের কলকোলাহলের কিছুঁই কিন্তু তাহার কানে আসিতেছিল না।
রাজা আসিতেছিল তাহার গা ঘেঁষিয়া। ওস্তাদের গৌরবে বুক তাহার ফুলিয়া উঠিয়াছে, সে পথ চলিতেছিল সভাকবির গৌরবতৃপ্ত রাজার মতই। অনর্গল সে লোকজনকে সাবধান করিতেছিল—হট যাও, হট যাও। এতনা নগিচয়ে কেঁও আত হ্যায়? হট যাও। উৎসাহের প্রাবল্যে আজ তাহার ভুল-হিন্দী বলার মাত্রা বাড়িয়া গিয়াছে। রাজার স্ত্রী ও ঠাকুরঝি একটু পিছনে আসিতেছিল। নিতাইয়ের আত্মীয়দের সহিত রাজার বউ গলগল করিয়া বকিতেছিল— তোমরা তো মা তাড়িয়ে দিয়েছিলে। এই তো ইস্টশান, তোমাদের বাড়ীর দুয়োর থেকে দেখা যায়; কই, কোন দিন নেতাইয়ের খোজ করেছ?
ঠাকুরঝি মেয়েটি অন্ধকারের মধ্যে ভীরু দৃষ্টি মেলিয়া, যে যখন কথা বলিতেছিল, তাহার মুখের দিকে চাহিতেছিল। পাশের গ্রামে তাহার শ্বশুরবাড়ী, মেলা উপলক্ষে সে আজ দিদির বাড়ী আসিয়াছে, রাত্রে এইখানে থাকিবে, ভোরে উঠিয়া চলিয়া যাইবে। তাহার বড় ইচ্ছা হইতেছিল ওস্তাদকে কয়টি কথা বলিতে!-তুমি এত সব কি ক’রে শিখলে? দিদির ঘরে গায়েন করতে, আমরা হাসতাম। বাবা, এত নোকের ছামুতে-ওই এত বড় কবিয়ালের সঙ্গে–বাবা! কল্পনামাত্রেই রাত্রির অন্ধকার আবরণের মধ্যে অপরের অজ্ঞাতে মধ্যে মধ্যে তাহার দৃষ্টি বিস্ময়ে বড় হইয়া উঠিতেছিল।
চণ্ডীতলা হইতে ডোমপাড়ার ভিতর দিয়াই স্টেশনের পথ। নিতাইয়ের কয়েকজন আত্মীয় আজ তাহাকে আহ্বান করিল—বাড়ী আয়।
নিতাইয়ের মা এখানে আর থাকে না, সে তাহার কন্যাকে আশ্রয় করিয়া গ্রামান্তরে জামাইয়ের বাড়ীতে থাকে। জামাই এ অঞ্চলের বিখ্যাত দাঙ্গাবাজ লাঠিয়াল। রাত্রে ডাকাতি করে, গোপনে মদ চোলাই করিয়া বিক্রয় করে, ভাঙা ঘরে বসিয়া পাকী মদ খায়, ও সের দরুনে মাছ কেনে। নিতাইয়ের মা শুধু ভাতের জন্য নয়—ওই পাকী মদ ও মাছের প্রলোভনেই সেখানে এখন বাস করিতেছে। নিতাই একবার নিজের ভাঙা ঘরটার দিকে চাহিয়া একটু হাসিল, বলিল,—না, আমার আস্তানাতেই যাই।
ঠিক এই মুহূর্তটিতেই একটা রূঢ় কণ্ঠের কয়েকটা কঠিন কঠিন বাক্য অতি অতর্কিতে কোন নিষ্ঠুর হাতের ছোড়া কয়েকটা পাথরের টুকরার মত নিতাইকে আসিয়া আঘাত করিল,—এই শূয়ার—যাবি কোথা? দাঁড়া!
এ তাহার মামার কণ্ঠস্বর। মামা এখানকার কুলাধিপতি। তাহদের স্বজাতিদের নৈশাভিযানের দলপতি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ।
নিতাই চমকিয়া উঠিল।
পাড়ার গলিমুখ হইতে মামা নামিয়া আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইল—প্ৰহলাদের সম্মুখে হিরণ্যকশিপুর মত। এবং খপ করিয়া তাহার টুঁটি টিপিয়া ধরিয়া বলিল—তোর বাবাকে দাদাকে গাল খাওয়ালি খাওয়ালি—আমার বাবাকে দাদাকে গাল খাওয়ালি ক্যানে আসরের মধ্যিখানে? শূয়ারের বাচ্চা শূয়ার!
একমুহূর্তে হতভম্ব হইয়া গেল সকলে। রাজন পর্যন্ত। নিতাইয়ের মামার হাত সাঁড়াশীর চেয়েও শক্ত। লোহার তালা ওই হাতের মোচড়ে মট করিয়া ভাঙিয়া যায়। নিতাইয়ের শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু সে কবিগান করিলেও ওই মামারই ভাগিনেয়, ওই বংশেরই সন্তান। দেহে শক্তি তাহারও কম নয়। তার উপর প্রথম জোয়ান বয়স। সে দুই হাত দিয়া মামার হাতখান টানিয়া ধরিল। পরমুহূর্তে রাজন আগাইয়া আসিল— ছোড়ো— !
মামার হত্যা করিবার সঙ্কল্প ছিল না। ইচ্ছা ছিল শাসনের। তাই নিতাইয়ের গলা ছাড়িয়া দিয়া বলিল—যাঃ। আর এ-পাড়ার পথ মাড়াবি না। মহাদেব কবিয়াল ওই একটা কথা ঠিক বলেছে। আস্তাকুঁড়ের অঁটো (এঁটে) পাতার স্বগ্গে যাবার আশা গো!—বলিয়া সে যেমন অতর্কিতে আসিয়াছিল—তেমনিই চকিতে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া গেল।
সমবেত লোকগুলি স্তব্ধ হইয়াই ছিল—স্তব্ধ হইয়াই রহিল। রাজন শুধু চীৎকার করিতে চেষ্টা করিল—ই ক্যা হ্যায়? ই ক্যা বাত? আঁঃ ৷ কেয়া, মগকে মুল্লুক হ্যায়?
পাড়ার ভিতর হইতে আর একটা হুঙ্কার আসিল—যা—যা, চেঁচাস না রে বেটা কুলী! —
নিতাই রাজনের হাত চাপিয়া ধরিল। বলিল–রাজন চুপ কর। চল। ই আমার পাপ ভাই। চল। বলিয়া হাসিয়া বলিল—আজ থেকে অকূলে ভাসলাম। সে অকূলে তুমিই আমার ভেলা।
রাজন তাহার হাত দুইটি চাপিয়া ধুরির গদগদ কণ্ঠে বলিল—তুমি সাচ্চ আদমী ওস্তাদ।
নিতাই আবার একটু হাসিল। পেছনে ফোঁস ফোঁস করিয়া কাঁদিতেছিল ঠাকুরঝি। রাজার স্ত্রী বলিল—মরণ! কানছিস ক্যানে লো!
ভিড় তখন কমিয়া গিয়াছে। সঙ্গের লোকজন অপেন আপন বাড়ীতে ঢুকিয়া পড়িয়াছে, নিতাই ও রাজার পরিবারবর্গ কেবল স্টেশনের পথে চলিল। কোয়ার্টারে আসিয়া রাজা,বলিল —কুছ খালেও ভাই ওস্তাদ।
নিতাই বলিল—গান শুনবে ভাই রাজন! ভাল গানের কলি এসেছে মনে। শুনবে?
রাজন বলিল—ঠ্যয়রো! ঢোলটো—
নিতাই হাত চাপিয়া ধরিল—না। শুধু গান।
বলিয়াই তাহার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ঈষৎ চাপিয়া গাহিল—